চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৫ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে অভ্যুত্থানের পাঁচ মাসের মাথায় ১০ ডিসেম্বর চাকসু নীতিমালা প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২৬ জানুয়ারি ওই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেটি জমা পড়েনি। নির্বাচনের কোনো রূপরেখাও তৈরি হয়নি। এতে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা।
নির্বাচনের রূপরেখা ও নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ‘অজুহাত’ হিসেবে নিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী ১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এ কারণে প্রায় প্রতিদিনই চলছে প্রস্তুতিমূলক সভা। এতে চাকসু নির্বাচনের সরব আলোচনায় ভাটা পড়েছে। তবে প্রশাসনের দাবি, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরে চাকসুর নির্বাচন হতে পারে। আর আগামী তিন মাসের মধ্যে তৈরি হবে নির্বাচনের রূপরেখা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ধ্রুব বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন চাকসু নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এখনো নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
এছাড়া আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারা, বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারা, নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করতে না পারাসহ নানা কারণে মনে হচ্ছে বর্তমান প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট সক্রিয় নয়।
এর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়, সেখানে সপ্তম দাবি ছিল ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ চালু করা’। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর আট মাস পার হয়েছে। এখনো দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি। ছাত্রসংসদ নির্বাচনের জন্য কোনো পথনকশা তৈরি করতে পারেনি প্রশাসন। অথচ বিষয়টির ওপর জোর দেওয়ার দরকার ছিল।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে চাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়বার নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, তাঁরা সমাবর্তন আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। এ বিষয়ে সমাবর্তনের পর কথা হবে। একই বিষয়ে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মো. কামাল উদ্দিন জানান, তাঁরা নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছেন। সমাবর্তনের পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করা হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে চাকসু নির্বাচনের রূপরেখা প্রস্তুত করা হবে। আর ডিসেম্বরের দিকে নির্বাচন আয়োজনের কথা ভাবছেন তাঁরা। তিনিও সমাবর্তন নিয়ে ব্যস্ততার কথা বলেছেন।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে চাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়বার নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর ছাত্রসংগঠনগুলোর মুখোমুখি অবস্থান, কয়েক দফা সংঘর্ষ ও উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্যাম্পাসে উগ্র মৌলবাদী শক্তির ভূমিকাও দেখা যাচ্ছে। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।
চাকসু নির্বাচনসহ ৯ দফা দাবিতে গত জানুয়ারিতে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার আন্দোলনের’ ব্যানারে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচি পালন করেন। পাশাপাশি প্রায় সব ছাত্রসংগঠনই চাকসু নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের সভায় চাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। নির্বাচনের বিষয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বলেন। তবে ছাত্রসংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো তাঁদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি। ফলে নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে নির্বাচনের আগে তাঁরা মামলায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার চান।
আলোচনার মাধ্যমে নীতিমালা সংশোধন চান ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, তাঁরা জুনের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছিলেন। কিন্তু সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য এটি পিছিয়ে গেছে। সমাবর্তনের পর এক থেকে দুই মাসের মধ্যে তাঁরা নির্বাচন চান। যদিও প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে তাঁদের এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মৌখিক আলোচনা হয়েছে।
চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো তাঁদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি। ফলে নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই।
বর্তমানে চাকসু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সুদীপ্ত চাকমা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্যাম্পাসে উগ্র মৌলবাদী শক্তির ভূমিকাও দেখা যাচ্ছে। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে শঙ্কা রয়েছে। দেশে নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর চাকসু নির্বাচন আয়োজন করা উচিত।’
১৯৯০ সালের সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি হয়। এই নেতৃত্ব পরে জাতীয় রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। এ রকম উদাহরণ দেশে রয়েছে। ফলে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী—দুই পক্ষের আস্থা আছে, এমন ব্যক্তিকে নিয়ে আসতে হবে।
আমার বার্তা/এল/এমই