ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্পের নান্দনিকতার ধারক নওগাঁর ‘লাবনী বেত ঘর

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

  মো: এ কে নোমান, নওগাঁ

নওগাঁ শহরের ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্প এখনও টিকে আছে কিছু কারিগরের অনন্য দক্ষতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে। আধুনিকতার জোয়ারে অনেক পুরনো শিল্প হারিয়ে গেলেও, নওগাঁর ‘লাবনী বেত ঘর’ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভাবন ঘটিয়ে বেঁচে আছে। এই বেত ঘরটি নওগাঁ সদরে কালিতলা এলাকার বিনাপানির মোড় নামক এলাকায় অবস্থিত। এখানে তৈরি হয় বেতের নানান কারুকাজ, যা শুধু জেলার ভেতরেই নয়, জেলার বাইরেও জনপ্রিয়। গৃহস্থালি ব্যবহারের সামগ্রী থেকে শুরু করে সাজসজ্জার উপকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পণ্য তারা উৎপাদন করে আসছে। তাদের পণ্যের চাহিদা এখনও টিকে আছে মান ও নান্দনিকতার জন্য।
 
নওগাঁর 'লাবনী বেত ঘর'-এ বিভিন্ন ধরনের বেতের পণ্য পাওয়া যায়। বেতের চেয়ার, টেবিল, ঝুড়ি, মোড়া (টুল), শোপিস, ছোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, খাট এবং ঝাড়বাতির পাশাপাশি অনেক আকর্ষণীয় পণ্য তৈরি হচ্ছে, যা গৃহস্থালি থেকে সাজসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বেতের চেয়ার ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয়, যা টেকসই ও নান্দনিক। বেতের টেবিলের দাম আকার ও ডিজাইন অনুযায়ী ৮০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া, ঘর সাজানোর জন্য ফুলদানি ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ছোটখাট গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য বেতের ঝুড়ি ও মাজনদানি ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। ঝাড়বাতি বিক্রি হয় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
 
এছাড়াও, বিশেষ কিছু পণ্য যেমন স্ট্যান্ড দোলনা (২৮০০থেকে ৩০০০ টাকা) এবং ঝুলন্ত দোলনা (১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা) বেশ জনপ্রিয়। বিলাসবহুল ডাইনিং টেবিলের দাম ৪০০০ থেকে ৮০০০ টাকার মধ্যে। এই বৈচিত্র্যময় পণ্য এবং তাদের গুণগত মানের জন্য ক্রেতাদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।
 
'লাবনী বেত ঘর'-এর মালিক শ্রী বিমল কুমার দাস বলেন, “আমাদের বাপ-দাদারা একসময় ধামা, ঝুড়ি, দাঁড়িপাল্লা ও অন্যান্য বেতের পণ্য তৈরি করতেন। সেই ঐতিহ্য আমরা ধরে রেখেছি। তবে বর্তমান সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আধুনিক ডিজাইন ও পণ্য তৈরি করছি, যেমন চেয়ার, টেবিল, দোলনা, ডাইনিং টেবিল ও ফুলদানি।”
 
তিনি আরও জানান, ২০০০ সাল থেকে তিনি এই ব্যবসায় জড়িত আছেন এবং স্থানীয় বাজার ছাড়াও নওগাঁর বিভিন্ন দোকানে তাদের তৈরি পণ্য পাইকারি ও খুচরা দামে বিক্রি হয়। বেতের মান উন্নত করার জন্য তারা চট্টগ্রাম থেকে বেত আমদানি করেন, যা মূলত আসাম, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসে।
 
লাবনী বেত ঘরের একজন কারিগর, শ্রী নারায়ণ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, “এই কাজ কষ্টের হলেও আমরা ভালোবাসা দিয়ে করি। আধুনিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের নতুন ডিজাইনের পণ্য আনতে হয়। আমাদের পণ্যের সবচেয়ে বড় গুণ হলো এটি পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী। ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আধুনিক ডিজাইন তৈরি করছি।”
 
কারিগরদের মতে, বেত শিল্পে আগের মতো কর্মসংস্থান না থাকলেও যারা এই শিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছেন, তারা এটি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ধরে রাখার জন্য লড়াই করছেন। শ্রী নারায়ণ আরও বলেন, “আমরা চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই শিল্পে আগ্রহী হোক। বেতের পণ্য কেবল ব্যবসা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
 
বেত শিল্পের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে কারিগরদের আরও সমর্থন প্রয়োজন। নওগাঁর বিভিন্ন স্থান যেমন শহরের প্রধান বাজার, উপশহর এবং আশেপাশের জেলাগুলোর দোকানে পাইকারি ও খুচরা দামে পণ্য বিক্রি হয়। ঢাকার কিছু দোকানে সরবরাহ করা হয় এবং ক্রেতারা বিশেষ অর্ডার দিয়ে নানান বেতের পণ্য কেনেন।
 
'লাবনী বেত ঘর' শুধুমাত্র একটি ব্যবসা নয়; এটি নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। শ্রী বিমল কুমার দাস এবং তার কারিগররা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন পণ্য তৈরি করছেন, যা স্থানীয় এবং জাতীয় বাজারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা এবং নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বিশেষ প্রয়োজন।