চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে কাজী নজরুল ইসলাম চেতনার বাতিঘর
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে কাজী নজরুল ইসলাম চেতনার বাতিঘর হিসেবে আন্দোলনকারীদের আলোড়িত ও জাগরিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন কবি আবদুল হাই শিকদার।
তিনি বলেন, কাজী নজরুল তার দ্রোহের রক্তে যে বাণী উচ্চারণ করেছেন সেই বাণী সেদিনও যেমন সত্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যেমন সত্য ছিল, চব্বিশের বিপ্লবেও তেমনি সত্য। এই বিপ্লবের সত্যিকার অর্থে চেতনার বাতিঘর কাজী নজরুল ইসলাম। এই বাতিঘর দিয়েই আলো বিস্ফোরিত হয়েছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা নজরুলের আলোয় আলোকিত হয়েছে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজে মাঠে স্থাপিত ‘স্বাধীনতা স্কোয়ার’ উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন নজরুল বিশেষজ্ঞ কবি আবদুল হাই শিকদার। উদ্বোধন শেষে রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজ অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত চিরকালের নজরুল : সমকালে সংগ্রামে শীর্ষক ‘আলাপচারিতা’ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরেণ্য কবি, বহুমাত্রিক লেখক ও নজরুল বিশেষজ্ঞ আবদুল হাই শিকদার বলেন, শিক্ষাঙ্গনে নজরুল স্মরণে 'স্বাধীনতা স্কোয়ার' স্থাপন দেশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। আমরা আশা করছি নজরুলের জাতীয় কবির গেজেট খুব দ্রুত হয়ে যাবে। তখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গৌরব করে বলতে পারবে ঊষালগ্নে অর্থাৎ প্রথম সূর্যোদয়ে এই প্রতিষ্ঠানে নজরুলের স্বাধীনতা স্কোয়ার স্থাপিত হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আলো, বাতাস, খাদ্য, পানি এই চারটি জিনিস প্রয়োজন। তেমনি যার মধ্যে একই সঙ্গে এই চারটি জিনিস পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে তিনি একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম। কবি অনেক থাকতে পারে কিন্তু নজরুল হল মানুষের আত্মার যে জগৎ, যে পৃথিবী, সেই পৃথিবীর নায়ক, মহানায়ক এবং কবি।
কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, যতবার পৃথিবীতে স্বাধীনতার জন্য মানুষ লড়াই করবে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, যতবার মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য কথা বলবে, যতবার আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য কথা বলবে, যতবার নারী মুক্তির কথা বলবে, যতবার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলবে, ততবার নজরুল আমাদের জন্য অনিবার্য।অন্য অনেককে ছাড়া আমাদের চলে কিন্তু নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
আবদুল হাই শিকদার আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি উচ্চারণে কবি নজরুলের লেখা অনিবার্য বিপ্লবের প্রতীক হয়ে স্লোগান, দেয়ালসহ প্রতিটি কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ নজরুলকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নজরুল স্কোয়ার নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে এজন্য রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজকে ধন্যবাদ জানাই। এর মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা নতুন প্রজন্মের কাছে আলোড়িত এবং জাগরিত হবে। এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন, পুলিশ সুপার ও রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন, রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. কে. এম জালাল উদ্দীন আকবর, কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রমুখ।
স্বাধীনতা স্কোয়ার স্থাপন প্রসঙ্গে রংপুর জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে স্থাপন করা হয়েছে 'চির উন্নত মম শির' শিরোনামে স্বাধীনতা স্কোয়ার। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই উপমহাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মনোজগতে বিরাজমান। তার গান ও কবিতা এবং প্রবন্ধ ও নিবন্ধ জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতীক। বৈষম্য এবং ভেদাভেদের বিরুদ্ধে ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্য তার লেখালেখি পৃথিবী যত দিন বিরাজমান থাকবে ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন সব থেকে বড় প্রাসঙ্গিক। এ কারণে দেখা গেছে, জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার সমস্ত উচ্চারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান কবিতা এবং প্রবন্ধ ও নিবন্ধন। আমরা মনে করেছি, তরুণ প্রজন্মের কাছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে চর্চার জন্য এর প্রতিটি প্রান্তে উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। এ কারণে আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণে স্বাধীনতা স্কোয়ার স্থাপন করেছি।
এদিকে উদ্বোধন শেষে সরেজমিনে দেখা গেছে, পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাকাডেমিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয়েছে নান্দনিক শিল্পসমৃদ্ধ স্বাধীনতা স্কোয়ার। মার্বেল পাথর এবং টাইলসে সুশোভিত করা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ম্যুরাল। সন্নিবেশন করা হয়েছে টুপি পরিহিত কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ছবিটি এমনভাবে ফুটে তোলা হয়েছে যেন বিদ্রোহের আগুন আছে, সাম্যের গান আছে। শোষণের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার আছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবিতা আছে। অর্থনৈতিক মুক্তির প্রেরণা আছে। মানুষে মানুষে ভালোবাসার গান আছে।
পাশে লেখা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বৈষম্যহীন মানবিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক কবিতাটির চার লাইন।
যেখানেই লেখা রয়েছে-
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তিপণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!’
উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সাল থেকেই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। শুধু কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট আইনেই তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা আছে। অন্তর্বর্তী সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোট গল্পসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান তুলনাহীন।
আমার বার্তা/এমই