মাছ নেই ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মৎস্য অভয়াশ্রমে
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:০৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ও আকচা ইউনিয়নের সুক নদীর তীরে বুড়ির বাঁধে আয়োজিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার উৎসব। বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার পর আশপাশের গ্রাম থেকে হাজারো মানুষ এই উৎসবে অংশ নেয়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঘোষিত মৎস্য অভয়াশ্রম বুড়ির বাঁধে ৩ জেলা হতে মাছ ধরার প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দিলেও মাছ না পেয়ে ফিরে গেছেন মৎস্য শিকারিরা। এতে অনেকের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খায়রুল ইসলাম বাঁধের গেট খুলে দিয়ে মাছ ধরা উৎসবের উদ্বোধন করেন। শরিবার সারাদিন সেখানে চলেছে মাছ ধরার উৎসব।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫১-৫২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এ অঞ্চলের কৃষিজমিতে সেচের সুবিধার জন্য এখানে একটি জলকপাট (সুইসগেট) নির্মাণ করা হয়। সারা বছর এই বাঁধে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও, প্রতি বছর পানি ছেড়ে দেওয়ার সময় মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়। এ সময় মৎস্য অধিদফতরের উদ্যোগে ছাড়া মাছের পোনা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদগুলো (আকচা ও চিলারং ইউপি) দেখভাল করে। প্রায় ৫০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বুড়ির বাঁধ এখন একটি মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দেখা যায়, জাল, পলো আর মাছ রাখার পাত্র খলই নিয়ে ভোর থেকেই বাঁধ এলাকায় জড়ো হয় হাজারো মানুষ। কেউ ভেলায়, কেউ ছোট নৌকায় করে মাছ ধরছেন। এ যেন মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। আর বাঁধে দাঁড়িয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনরা। মাছ ধরার জন্য আশপাশের কয়েক গ্রামের ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ যেন ভেঙে পড়েছে নদীর তীরে। এতে লোকে লোকারণ্য হয় এলাকাটি।
তবে মাছ ধরতে আসা সবারই অভিযোগ, মাছ না পাওয়ার। রাত থেকে জাল ফেলেও কাঙ্ক্ষিত মাছ পাননি অনেকেই। দেশীয় প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছর আগেও এই বাঁধে প্রচুর দেশীয় মাছ ধরা পড়ত। কিন্তু এখন মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছ। রোববার (১৯ অক্টোবর) অনেককে মাছ শিকারে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
শহর থেকে দেশীয় মাছ ক্রয় করতে যাওয়া ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেন, এখানে শহরের তুলনায় মাছের দাম অনেক বেশি। দেশীয় মাছ তেমন পাওয়া যায় না। যাও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু দাম অনেক। পুটি মাছ যেখানে বাজারে দাম ৩০০ টাকা এখানে চাওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা। তাই অনেক ক্রেতাই মাছ ক্রয় করতে না পেরে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
সদর উপজেলার নারগুন এলাকা থেকে মাছ ধরতে আসেন রমজান আলী। কয়েক ঘণ্টা ধরে টানা জাল ফেলেও হতাশ হতে হয় তাকে। আধা কেজী মাছও ওঠেনি তার জালে। অবশেষে জাল গুটিয়ে নেন তিনি। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, এই উৎসব আর আগের মতো নেই। এখানে আর সাধারণ মানুষ মাছ ধরতে আসবে না। কারণ বাঁধের আশপাশে যাদের জমি রয়েছে তারা চারদিকে ঘিরে খাবার দিয়ে মাছ আটকে রেখেছে। এছাড়া বাঁধের পানিতে শত শত নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন করে চলতে থাকলে এই উৎসব একদিন হারিয়ে যাবে।
শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত মাছ শিকারে বাঁধে সময় কাটান খোকন আলী। অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, মাছগুলো ঘেরে আটকে দেওয়া হয়েছে। এখানে মৎস্য উৎসবের চেয়ে তামাশা চলছে বেশি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেন চারদিকে ঘের দিয়ে রেখেছে প্রভাবশালীরা। খাবার দিয়েছে ঘেরে। আমরা যারা দূর থেকে মাছ ধরতে এসেছি তারা এখানে বেকার সময় নষ্ট করছি।
আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মাছ ধরা দেখতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, উৎসবটি আর ঐতিহ্যবাহী মৎস্য উৎসব নেই, ব্যক্তি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সামাজিকভাবে এর সমাধান দরকার। নয়তো একদিন এই উৎসব হারিয়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই এখানে উৎসব দেখে বড় হয়েছি। এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে দিনটি মিশে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়।
এখানে আগের মতো ভাতৃত্ববোধটুকুও নেই। আগে এমন ঘের ছিল না। উন্মুক্তভাবে মাছ শিকার করতাম আমরা। এখন এখানে ঘের দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সারাবছর নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। এখন আবার ঘের দিয়ে মাছ আটকে রেখেছে প্রভাবশালীরা। আমরা যেখানে জাল ফেলছি এখানে হাজার হাজার জাল পড়ছে। এখানে পানিও অনেক, তবে মাছ নেই। বাঁধের আশপাশে যাদের জমি আছে এ উৎসব শুধু তাদের জন্যই বলে মনে হচ্ছে এখন। এখানে আমাদের কিছুই বলার নেই।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরাফাত উদ্দিন আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছর বাঁধের পানিতে কমবেশি মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। পরে তা এলাকাবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এখন সেই মাছ ধরতে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছেন। মাছ ছাড়ার পর থেকেই কিছু অসাধু ব্যক্তি পোনামাছ নিধনে রিং জাল বসিয়ে রাখে। এসব খবর পাওয়ার পর মাঝমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে জাল পুড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। তারপরও যদি মাছ না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।
ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী যাকারিয়া বলেন, আমরা আশা করি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মাছের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে মাছ না পেয়ে অনেকে কেন খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এড়িয়ে যান।
আমার বার্তা/জেএইচ