সংসদীয় আসন নারায়ণগঞ্জ-৩ : নিজের ঘরেই পুড়ছে বিএনপি
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:১২ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজের ঘরেই এখন পুড়ছে বিএনপি। মনোনয়ন প্রত্যাশী এবং খসড়া মনোনয়ন প্রাপ্ত , দুই পক্ষেরই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও মশাল মিছিলের পাশাপাশি কটু বাক্যের ঝাঁঝালো বক্তব্যে বিরোধের আগুন এখন প্রকাশ্যে জ্বলছে। এদিকে এই বিরোধকে কেন্দ্র করে পণ্যের মতই কেনা-বেচার ধুম পড়েছে মাঠের লোকজনদের। এসব কিছুই হচ্ছে এখন ৩১ দফার প্রচারণার অজুহাতে। এতে বিএনপিকে নিয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরী হয়েছে। আর এই ধারণা শেষ অবধি ভোটের মাঠে বিএনপি’র উপর কেমন প্রভাব পড়ে তা-ই দেখার বিষয়।
নির্বাচন কমিশন কতৃক সীমানা পুন:নির্ধারণের পর নারায়ণগঞ্জ-৩ সংসদীয় আসনটি সোনরগাঁ এর সাথে যুক্ত হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ। আসনটিতে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৮৩ হাজার। এআসনে ধানের শীষের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় ছিলেন ৮ নেতা। এদের সকলেরই রয়েছে রাজনৈতিক। তবে এরমধ্যে মূল ফোকাসে ছিলেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রেজাউল করিম। এছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় ছিলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ঝানু আমলা অলিউর রহমান আপেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রিয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বকুল, সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার আবু জাফর ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি ব্যাবসায়ী আল মুজাহিদ মল্লিক। দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি এই আসনে একজন ত্যাগী, সৎ এবং মেধাসমৃদ্ধ ব্যাক্তিকে মনোনয়ন দিবে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ৩ নভেম্বর বিএনপি তাদের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রাপ্ত হিসেবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মান্নানের নাম ঘোষণা করে। এরপরই শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। সাধারণের মাঝেও এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। আলোচনায় উঠে আসে ঘোষিত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের গত পনের বছরে দলের জন্য অনেক ত্যাগ রয়েছে। কিন্ত ২৪ এর ৫ আগষ্ট দুপুরে ফ্যাসিবাদের পতনের পর অপরাহ্ন থেকেই মান্নান ও তাঁর ছেলে সজীব এবং পিএস সেলিমের নেতৃত্বে সোনারগাঁ জুড়ে ব্যাপক অপকর্ম শুরু হয়। পত্র-পত্রিকাগুলোতে এসবের কিঞ্চিৎ উঠে আসে। তার ইশারায় জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে শহীদ ও আহতের ঘটনায় দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় স্থানীয় একাধিক সাংবাদিককেও আসামী করা হয়। এছাড়া গত পনের মাস ধরেই চলছে বাপ বেটার দু:শাসন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে মান্নানের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার বিষয়ে। মূর্খ মান্নান হিসেবেই মানুষ তাঁকে চিনেন। এতে করে সাধারণ ভোটার এবং ভিন্নমতের মানুষদের মাঝে বিএনপি’র ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একপর্যায়ে “মূর্খ” মান্নান ইস্যুতে বাকী সাত মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে ঐক্য হয়। এই ইস্যুতে গত ১৭ নভেম্বর সকল প্রার্থীরা মিলে রুদ্রতার মিটিং করেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও ৪ বারের সাংসদ অধ্যাপক রেজাউল করিমের বাসভবনে। তারই ধারাবাহিকতায় সকল প্রার্থীর যৌথ স্বাক্ষরে প্রার্থীর পরিবর্তন চেয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বরাবর আবেদন করেন। এতে একজন সৎ, শিক্ষিত এবং গ্রহনযোগ্য ব্যাক্তিকে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন । পরবর্তীতে ১৮ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের উদ্যোগে মান্নানের মনোনয়ন বাতিলের দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ । এদিকে সেদিন বিকেলেই সিদ্ধিরগঞ্জের ৬ নং ওয়ার্ডে মান্নানের ৩১ দফার প্রচারণার অনুষ্ঠানে মানববন্ধনের বিরুদ্ধে ব্যাণার টানিয়ে করা হয় প্রতিবাদ সভা। রাতেই মান্নানের ছেলের নেতৃত্বে সোনারগাঁয়ে বিক্ষোভ মিছিলে শ্লোগান দেওয়া হয় “অধ্যাপক শয়তানেরা, হুশিয়ার সাবধান”! এরপর থেকেই চলছে একদিকে মান্নান বিরোধীদের হাজারো নারী-পুরুষের মশাল মিছিল অপরদিকে মান্নানের নির্বাচনী প্রচারণার সভাগুলো থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের টার্গেট করে বিশোষগার! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শালীনতা বিবর্জিত ভাষায় মান্নান পক্ষের লোকজনের কুৎসা রটানো। মান্নানের উপস্থিতিতেই অনেক বক্তা কুৎসা রটাচ্ছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রতিপক্ষ গ্রুপের বিরুদ্ধে। মান্নান নিজেও তাদের লক্ষ্য করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এরই মধ্যে মান্নানের মনোনয়ন বাতিলের তাঁর বিরোধী মনোনয়ন প্রত্যাশী জোট গত ২২ নভেম্বর সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর বালুর মাঠে সমাবেশ এবং শেষে মহাসড়কে বিক্ষোভ করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রেজাউল করিম। সর্বশেষ গত রোববার সিদ্ধিরগঞ্জে এক সভায় মান্নান বলেছেন, এখন যারা নতুন করে এসেছেন তাঁরা দলে নতুন যোগদান করেছেন। এক কথায় মান্নানের নির্বাচনী সভাগুলোতে ৩১ দফার প্রচারণা নেই বললেই চলে। শুধুই নিজ দলের প্রতিপক্ষ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে বদনাম, ক্ষোভ ও বিশোষগার চলে বক্তব্য জুড়ে। এক দু’ লাইন থাকে ধানের শীষের ভোটের কথা।
অপরদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কয়েকজন প্রভাবশালী সাংবাদিক মান্নানের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়ে পত্রিকার কাটিং জুড়ে দিয়েছেন। টেলিভিশনের ডিজিটাল সাইটে মান্নানকে নিয়ে কনটেন্ট প্রচার হচ্ছে। এছাড়াও মান্নানকে নিয়ে নামে-বেনামের পেইজগুলোতে ট্রল হচ্ছে।
এই সুযোগে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী ড. ইকবাল হোসেন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তাঁর বক্তব্যে সোনারগাঁয়ে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বিএনপির অপকর্মের কথা উঠে আসছে। সম্প্রতি গনসংহতি আন্দোলনের নেতা অঞ্জন দাস সোনারগাঁয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির প্রার্থীর ব্যাপক অপকর্মের কথা বক্তব্যে বলেছেন।
সব মিলিয়ে এখন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নিজের ঘরের আগুনেই পুড়ছে। নির্বাচনী বৈতরণী পাড় হওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে বলেই মনে করছেন বিএনপি’র নেতা-কর্মীরাই!
আমার বার্তা/এমই
