ছিনতাইকারী সন্দেহে আটক, ঘোষণা দিয়ে দলবল নিয়ে খুন
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:৪২ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
চট্টগ্রামে ৪০ দিন আগে 'মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা' গানে নেচে গেয়ে শাহাদা হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে নগর পুলিশ (সিএমপি)। মূলত ছিনতাইকারী সন্দেহে ওই যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যারকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন ‘চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের প্রধান অ্যাডমিন ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী জুয়েল নামের এক ভাসমান ব্যবসায়ী। ঘটনার ৪০ দিন পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য তুলে ধরেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী প্রকাশ জুয়েল (৪২), মো. সালমান (১৬) এবং আনিসুর রহমান ইফাত (১৯)। এদের মধ্যে কেবল ইফাতই ছাত্র। মঙ্গলবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নগরের ২ নম্বর গেট ও শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গণপিটুনিতে খুনের শিকার মো. শাহাদাত হোসেন নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার পাঁচবাড়িয়া ইউনিয়নের নদনা গ্রামের মিয়া জান ভুঁইয়া বাড়ির মৃত মোহাম্মদ হারুনের ছেলে। তিনি স্ত্রী শারমিন আক্তারকে নিয়ে নগরের কোতোয়ালী থানার বিআরটিসি এলাকার বয়লার কলোনিতে থাকতেন।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, মূলত ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১৩ আগস্ট। ঘটনার পর ভিকটিম শাহাদাতের মরদেহ তারা প্রবর্তক মোড় এলাকায় ফেলে রাখে। একদিন পর ১৪ আগস্ট পুলিশ দেখতে পেয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে। এর আগের দিন দুই নম্বরগেট এলাকায় শাহাদাত হোসেনকে কয়েক দফায় গান গেয়ে গেয়ে তাকে মারধর করেন। একপর্যায়ে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
এরপর ভিকটিমের বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা করে। মামলা দায়েরের পরপরই পুলিশ আসামিদের শনাক্তে কাজ শুরু করে এবং মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) অভিযান চালিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পৃথকভাবে ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আসামিদের জিজ্ঞাবাদের বরাতে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার তিনজনসহ আনুমানিক ২০ জনের অধিক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। পুলিশ বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে, আসামিদের সাথে ভিকটিমের কোনো ধরনের পূর্ব পরিচয় ছিল না। ভিকটিমকে ছিনতাইকারী সন্দেহে মারধর করা হয়। এক দলের পর আরেক দল এসে তাকে দফায় দফায় মারধর করে।
তারেক আজিজ বলেন, মূলত 'চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ' নাম দিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে আসামি জুয়েল। সেই গ্রুপের সদস্য ১৩০ জন। জুয়েল তার পরিচিত সার্কেলের মানুষদের ওই গ্রুপটিতে যুক্ত করে। গ্রুপটি ছাত্র জনতার নাম দিয়ে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছিল। সরকার পতনের পরে ট্রাফিকিংয়ের জন্য পুলিশের অনুমোদনকৃত কোনো ট্রাফিক গ্রুপ ছিল না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্যোগী হয়ে অনেকে ট্রাফিকিংয়ে সহায়তা করেছে। কিন্তু তারা এই গ্রুপের সদস্য নয়।
তাকে পেটানোর আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঘোষণা দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ভিকটিমকে বেঁধে পেটানোর সময় চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপে ভিডিওটা দেওয়া হয়। তখন গ্রুপে বলা হয় একজনকে ধরা হয়েছে যিনি মোবাইল চোর বা ছিনতাইকারী। তাকে মারতে হবে সবাই আসেন। এরপর একে একে দলে দলে গিয়ে তাকে পেটানো হয়।
এডিসি তারেক আজিজ বলেন, ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপের অ্যাডমিন ফরহাদ আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বেই এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তবে সে ইট-ভালু ও সিমেন্টের ভাসমান ব্যবসা করে। আরেক আসামি যার বয়স ১৬, নাম সালমান। সেও কিন্তু ছাত্র নয়। সে ঘুরেফিরে বেড়ায় মূলত। আর আনিসুর রহমান ইফাত নামে যাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি সে চান্দগাঁও এলাকার একটি কলেজের ছাত্র।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ভিকটিম মূলত দিনমজুর। তার নির্দিষ্ট পেশা নেই। তাকে ওই এলাকায় দেখে সন্দেহের ভিত্তিতেই মারধর করা হয়। আপনারা একটি নাম শুনেছেন মব জাস্টিস নামে। এটি মব ইনজাস্টিস হতে পারে। শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতেই তাকে বেশ কয়েক দফায় মারধর করে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে।
পুলিশ জানিয়েছে, ভিকটিম শাহাদাতের বিরুদ্ধে নগরীর কোতোয়ালী থানায় ৬টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে চারটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা এবং আরেকটি চুরির অভিযোগে হয়েছে।
এর আগে, গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক গোল হয়ে গাইছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ‘মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা’। কেউ মুখ দিয়ে বাজাচ্ছেন বাঁশি, কেউ করছেন উল্লাস। ঠিক তাদের মাঝখানেই নীল রঙের গেঞ্জি এবং জিন্স প্যান্ট পড়ে শাহাদাত নিস্তেজ হয়ে ঢুলছেন। তার দুই হাত বেঁধে রাখা হয়েছে স্টিলের পাইপের সাথে। গান গেয়ে গেয়েই পিটিয়ে নৃশংস ও নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিডিওটি নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকার। যার মরদেহ গত ১৪ আগস্ট নগরের প্রবর্তক মোড়ের অদূরে বেসরকারি একটি হাসপাতালের সামনে রাস্তা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। এরপর ১৫ আগস্ট শাহাদাতের বাবা মোহাম্মদ হারুন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে শাহাদাতের চাচা উল্লেখ করেন, গত ১৩ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন শাহাদাত। সারাদিন পর তার স্ত্রী শারমিন সন্ধ্যার দিকে ফোন করলে তিনি জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় যাবেন। রাত বেশি হওয়ার পরেও শাহাদাত বাসায় না ফেরায় তাকে ফোন করেন শারমিন। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। এর পরদিন শাহাদাতের চাচা সকাল ৯টার দিকে ফেসবুকে দেখেন, নগরীর প্রবর্তক মোড়ের অদূরে বদনাশাহ মিয়া (রহ.) মাজারের বিপরীতে সড়কের পাশে তার ভাতিজার মরদেহ পড়ে আছে। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আমার বার্তা/এমই