৪০০ কোটির পিয়ন জাহাঙ্গীরের ‘ভাতিজা’ পরিচয়ে শতকোটি কামাই এসআইয়ের
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন
পেশায় পুলিশ কর্মকর্তা, কিন্তু দাপট দেখাতেন জাহাঙ্গীর আলমের ‘ভাতিজা’ পরিচয়ে; সেই জাহাঙ্গীর, যিনি কিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪০০ কোটি টাকার পিয়ন হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত ইতোমধ্যে। অভিযোগ আছে, জাহাঙ্গীরের ‘ভাতিজা’ হওয়ার দাপট দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন নিজের পুরো ডিপার্টমেন্টকে। এমনকি তাকে সমীহ করে চলতেন জেলার এসপি পর্যন্ত। বিগত সরকারের আমলের এমনই এক দাপুটে এসআইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে কুমিল্লা জেলা পুলিশে, যার নাম জয়নাল আবেদীন।
জানা গেছে, কুমিল্লা জেলা পুলিশের রিজার্ভ অফিসার (আর.ও-১) থাকার সুবাদে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন এসআই জয়নাল আবেদীন। এ পদে বসে শুধু কুমিল্লাতেই নয়; ঢাকা ও নোয়াখালীতেও স্ত্রী, শ্বশুর, স্বজন এবং নিজ নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। নিয়োগ, বদলি ও নানা তদবির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, পুরো জেলার পুলিশের এসআই, এএসআই, কনস্টেবল পদে বদলির প্রস্তাব তৈরি ও তদারকি করেন আর.ও-১। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪০০ কোটি টাকার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলমের ‘ভাতিজা’ পরিচয়কে অবলম্বন করে নিজের পদের পূর্ণাঙ্গ অপব্যবহার করেছেন জয়নাল আবেদীন। নিয়োগ, বদলি ও তদবির বাণিজ্যে ঘুরিয়েছেন ছড়ি।
ক্ষমতার দাপটে শুধু দুর্নীতিই নয়, নারী পুলিশ সদস্যদের উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করতেন বলেও অভিযোগ আছে এসআই জয়নালের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করেও না কি প্রতিকার মেলেনি কোনো ভিকটিমের।
জানা যায়, নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার খিলপাড়ার বাসিন্দা অভিযোগের স্তূপে নিমজ্জিত এ পুলিশ কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আস্তানা গাড়েন কুমিল্লা জেলা পুলিশে। জেলার একাধিক ইউনিটে চাকরি করার পর বিয়ে করেন নাঙ্গলকোট থানার ভুশ্চি এলাকায়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিওন জাহাঙ্গীর আলমের প্রভাবে বাগিয়ে নেন জেলা পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদ আর.ও-১।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আর.ও-১ পদে বসে জয়নাল এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল পদে বদলি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। গুরুত্বপূর্ণ থানা, ফাঁড়ি, তদন্তকেন্দ্র এবং বিভিন্ন ইউনিটে পোস্টিং বাণিজ্য করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। কোনো পুলিশ সদস্য কিংবা কর্মকর্তা জয়নালের চাহিদা অনুসারে ঘুষ দিতে রাজি না হলে তার ঠিকানা হতো পাহাড়ি অঞ্চলে। জেলার সব থানা ফাঁড়ি ও তদন্তকেন্দ্রে ক্যাশিয়ার ও মুনশিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন এসআই জয়নাল। অর্থের বিনিময়ে করতেন মাদকসহ বিভিন্ন মামলার তদবিরও।
ভুক্তভোগী এক সাব-ইনস্পেকটর বলেন, আর.ও-১ জয়নাল সকালে ভুয়া বদলির আদেশ দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিকেলে আবার তা প্রত্যাহার করে নিতেন। এসআই টিপু বিশ্বাস বলেন, আর.ও-১ জয়নাল আমাকে হয়রানি করে এক মাসে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসআই মোহাম্মদ সোহেল বলেন, আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে এক মাসের মধ্যে আবার আমাকে জেলা থেকে বের করে দিয়েছেন।
কুমিল্লা পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছর আর.ও-১ পদে বহাল ছিলেন এসআই জয়নাল। দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে দফায় দফায় বদলির আদেশ করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনার বিতর্কিত পিয়ন জাহাঙ্গীরকে প্রটোকল দিয়ে কুমিল্লায় এনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। শেষমেশ ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পদাবনতি দেওয়া হয় তাকে। এসআই থেকে তিন বছরের জন্য এএসআই করা হয় জয়নাল আবেদীনকে। কিন্তু পিয়ন জাহাঙ্গীরের প্রভাবে দেড় বছরের মধ্যে আবারও এসআই পদে বহাল করা হয় তাকে।
ওই বছরই রংপুরে বদলি করা হয় বিতর্কিত এ পুলিশ কর্মকর্তাকে। সেখানে থানা এবং ডিএসবি মিলিয়ে চার বছর কাটান। পরে ২০২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি করা হয় এসআই জয়নালকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশে যোগদানের পরপরই নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে আবারও ক্লোজ করা হয় তাকে। তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দুটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়। প্রায় এক বছর জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে সংযুক্ত থাকার পর আবার প্রভাব খাটিয়ে আশুগঞ্জ থানায় পোস্টিং নেন এসআই জয়নাল। বর্তমানে ওই থানার সেকেন্ড অফিসার পদে দায়িত্বরত আছেন তিনি।
কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকার বাসিন্দা ইফতেখার আহমেদ বলেন, বাগিচাগাঁও এলাকায় এসআই জয়নালের ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মার কাছে ভবনটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নগরীর পৃথক এলাকায় তার আছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট।
নাঙ্গলকোট উপজেলার ভুশ্চি এলাকার মোবারক হোসেন বলেন, এসআই জয়নালের শ্বশুর পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। অথচ তার জমি ২০-৩০ বিঘার নিচে হবে না। চতুর জয়নাল বিঘায় বিঘায় কৃষিজমি কিনেছেন শ্বশুরের নামে।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসআই জয়নাল আবেদীন। তার ভাষ্য, ষড়যন্ত্র করে নারী দিয়ে বারবার তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এসব ঘটনায় বিভাগীয় শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাকে।
এদিকে শতকোটি টাকার সম্পদের কথা অস্বীকার করলেও কুমিল্লায় নিজের নামে একটি বাণিজ্যিক ভবন আছে বলে স্বীকার করেছেন এসআই জয়নাল আবেদীন।
আমার বার্তা/জেএইচ