শ্রম আইন সংশোধন : যা যা জানা জরুরি

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

  রানা এস এম সোহেল:

দেশের তৈরি পোশাক, ট্যানারি, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিকাঠামো এত দিন পাঁচ বছর পরপর নির্ধারণ হয়ে আসছিল। কিন্তু এ সপ্তাহে শ্রম আইন সংশোধনের ফলে এখন থেকে মজুরিকাঠামো তিন বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।এ ক্ষেত্রে তিন বছর পরপর বিভিন্ন শিল্প খাতের শ্রমিকের মজুরি বাড়বে। সংশোধিত শ্রম আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে।

সংশোধিত এই আইনে, মোটা দাগে বলা যায়, শ্রমিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট করার পাশাপাশি মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ প্রতিস্থাপন, ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান, প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন শ্রমিক থাকলে ভবিষ্য তহবিল বাধ্যতামূলক, মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন, বার্ষিক উৎসব ছুটি ১১ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৩ দিন করাসহ উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জাতীয় ও খাতভিত্তিক ত্রিপক্ষীয় পরিষদ গঠন, জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ছাড়া কোন কোন আচরণ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হবে সেগুলোও আইনে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত, জাতীয়তা, সামাজিক অবস্থান, বংশ বা প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আলাদা করা, বাদ দেওয়া বা কম গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত রয়েছে আইনে।

সরকার গত সোমবার রাতে শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই আইন সংশোধনের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। এর আগে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) সভায় কোন কোন বিষয়ে সংশোধন হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য হয়।

সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে শ্রমিকনেতারা সন্তোষ প্রকাশ করলেও শিল্পমালিকেরা কয়েকটি বিধান নিয়ে ক্ষুব্ধ। তাঁদের দাবি, শ্রমিকের সংজ্ঞায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে আসায় বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রমিকের সম্মতির সংখ্যা এবং ভবিষ্য তহবিল নিয়ে টিসিসি সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি।

জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। আইনটি শ্রমিকবান্ধব হলেও মালিকপক্ষের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। এটি বাস্তবায়নে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার দাবি করেছিলাম। সেটি হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো হবে।’

জানা গেছে,এত দিন কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগত। এখন থেকে শতকরা হারটি থাকছে না, ন্যূনতম ২০ জনের সম্মতি থাকলেই ইউনিয়ন করা যাবে। মূলত ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কারখানার মোট শ্রমিকসংখ্যার বিপরীতে কতজনের সম্মতি লাগবে, সেটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক থাকলে ট্রেড ইউনিয়ন করতে ২০ জনের সম্মতি লাগবে। এ ছাড়া ৩০১ থেকে ৫০০ শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ জন, ৫০১ থেকে ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০০ জন, ১ হাজার ৫০১ থেকে ৩ হাজার শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০০ জন এবং ৩ হাজার ১ থেকে এর বেশি শ্রমিক থাকলে ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে। একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পাঁচটির বেশি ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না। এত দিন সর্বোচ্চ তিনটি করা যেত।

এত দিন শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধার জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠনের কথা বলা থাকলেও তা বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে এবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই মালিকপক্ষকে কর্মীদের জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে হবে। তবে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে ভবিষ্য তহবিল করা থেকে অব্যাহতি পাবে মালিকপক্ষ। সে ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মালিক ৫০ শতাংশ ও শ্রমিক ৫০ শতাংশ চাঁদা দেবেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, টিসিসির বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখান থেকে সরে গিয়ে সরকার অন্য কারও স্বার্থে বা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রম আইন সংশোধন করেছে। এতে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রমিক অসন্তোষ বাড়বে। শ্রম আইন সংশোধনে আগামী মার্চ পর্যন্ত সময় থাকলেও তড়িঘড়ি করে কেন এমন করল, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

অতীতে দেখা গেছে, মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হতেন শ্রমিকেরা। আন্দোলন ঠেকাতে শিল্পমালিকেরা অনেক সময় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি তাঁদের কালোতালিকাভুক্ত করতেন। তখন শ্রমিকদের নতুন কারখানায় চাকরি পাওয়া কঠিন হতো। সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের কালোতালিকাভুক্ত করার বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মালিক বা মালিকদের সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে শ্রমিক সংগঠন গঠনে উৎসাহ দেওয়া যাবে না। পক্ষপাতমূলকভাবে বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের বরখাস্ত এবং অন্য ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করা যাবে না।


আমার বার্তা/এমই