ভূ-রাজনীতি পাল্টে দেবে পাকিস্তান-সৌদি আরব প্রতিরক্ষা চুক্তি?
নিবিড় পর্যবেক্ষণে ভারত
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের স্বাক্ষরিত কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি। বুধবার রিয়াদের আল-ইয়ামামাহ প্রাসাদের রাজ দরবারে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সৌদি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান, লাল গালিচা এবং রাজকীয় প্রটোকলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রায় আট দশকের পুরোনো এই মিত্রতার ইতিহাসে এটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
চুক্তির প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব
এই চুক্তি এমন এক সময়ে হলো, যখন আঞ্চলিক রাজনীতিতে অস্থিরতা চরমে। গত দু'বছর ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসন, বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে হামলা, মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা উদ্বেগ আরও বেড়েছে। একই সময়ে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাও বেড়েছে। সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাত দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এই চুক্তি দুই দেশের নিরাপত্তা জোরদার ও আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের ‘যৌথ অঙ্গীকার’কে তুলে ধরে। এটি যেকোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘যৌথ প্রতিরোধ ক্ষমতা’ বাড়ানোরও অঙ্গীকার। চুক্তিতে বলা হয়েছে, কোনও দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হলে তা উভয় দেশের ওপর আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হবে।
ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আসফান্দিয়ার মীর এই চুক্তিকে দুই দেশের জন্যই একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, শীতল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল, কিন্তু তা সত্তরের দশকে ভেস্তে যায়। চীনের সঙ্গে ব্যাপক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা থাকলেও পাকিস্তানের কোনও আনুষ্ঠানিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই।
ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও সামরিক সহযোগিতা
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর যে কয়েকটি দেশ সবার আগে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। ১৯৫১ সালে দুই দেশ একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা কয়েক দশক ধরে কৌশলগত, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করে। এর পর থেকে বহুবার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সৌদি আরবে দায়িত্ব পালন করেছে এবং সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সাল থেকে পাকিস্তান ৮ হাজারের বেশি সৌদি সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
সিডনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা গবেষক মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, এই চুক্তি পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের সঙ্গেও একই ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা শুরু করার একটি মডেল হতে পারে। চুক্তিটি পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দুই দেশের মধ্যে যৌথ প্রশিক্ষণ, সামরিক উৎপাদন এবং সৌদি আরবে পাকিস্তানি সেনার উপস্থিতি আরও বাড়ানোর পথ খুলে দেবে।
চুক্তির প্রভাব ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
এই চুক্তিকে পাকিস্তানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দুই দেশের সম্পর্ক এমনিতেই ঐতিহাসিক সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এই চুক্তির ফলে ভারত-পাকিস্তানের ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, আমরা এই চুক্তির বিষয়ে অবগত। আমরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাব নিয়ে পর্যালোচনা করব।
তবে মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, এই চুক্তি পাকিস্তানের আপেক্ষিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
পারমাণবিক ঢাল ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। তবে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা বারবার অস্বীকার করেছে। মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড একটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটরকে বলেছিলেন, আমার বোমা বানানোর জন্য ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন নেই। আমি চাইলে পাকিস্তানের কাছ থেকে একটি বোমা কিনে নেব।
তবে বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, যদিও পাকিস্তান আগেও প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, তবে এর কোনোটিই পারমাণবিক নিশ্চয়তা তৈরি করেনি। এই চুক্তিতেও সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই।
আসফান্দিয়ার মীর সতর্ক করে বলেছেন, এই চুক্তি দুই দেশকেই একে অপরের আঞ্চলিক উত্তেজনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পাকিস্তান এখন সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে, সৌদি আরবও পাকিস্তানের বিরোধে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে, জড়িয়ে পড়তে পারে।
আমার বার্তা/এমই