ইসরায়েলি আগ্রাসন, শত্রুতা ভুলে যেভাবে আবার ঘনিষ্ঠ সৌদি আরব-কাতার
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১২ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ক্রমেই বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব ধরনের শত্রুতা ভুলে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে আরব দেশগুলো। সম্প্রতি ‘ঐতিহাসিক’ রেলচুক্তির মাধ্যমে তার ভিত গড়া শুরু করেছে উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব ও কাতার। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পকে সামনে রেখে দুই এই দুই রাষ্ট্র যেভাবে কাছাকাছি এসেছে, তা আরব বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করছে।
সম্ভাব্য ইহুদি আগ্রাসনের ভয়েই কি এই ঘনিষ্ঠতা ফিরছে বলে মনে করছেন অনেকে।
চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর আরবের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চগতির বৈদ্যুতিক যাত্রিবাহী চালু করছে সৌদি আরব ও কাতার। এই ট্রেনের মাধ্যমে শত্রুতা ভুলে দুই দেশের রাজধানীকে একসঙ্গে জুড়ে ফেলতে চাইছে তারা। ইতোমধ্যে চুক্তিও করে ফেলেছে সৌদি ও কাতার। প্রস্তাবিত প্রকল্পে রিয়াদ থেকে দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত পাতা হবে ৭৮৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন। শুধু তা-ই নয়, এর মাধ্যমে দেশের একজোড়া শহরকেও যুক্ত করার স্বপ্ন দেখছেন সৌদি যুবরাজ তথা দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন-সালমান। সেগুলো হলো- আল-হোফুক এবং দাম্মাম।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত রেললাইন দিয়ে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) বেগে ট্রেন ছোটাতে চান সৌদি যুবরাজ। সেক্ষেত্রে জাপানি বুলেট ট্রেনের স্বাদ পাবে পশ্চিম এশিয়ার দুই মরুর দেশ। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র দু’ঘণ্টায় রিয়াধ-দোহায় যাতায়াত করতে পারবেন সেখানকার বাসিন্দারা। বর্তমানে বিমানে ওই দুই রাজধানী শহরে যাতায়াত করতে সময় লাগে প্রায় ৯০ মিনিট। তবে সময় সামান্য বাড়লেও খরচ কমতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
সম্প্রতি কাতার-সৌদি সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকের আয়োজন করে রিয়াদ সেখানে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন-সালমানের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি। প্রস্তাবিত রিয়াদ-দোহা রেল প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দেন তারা। পরে এই ইস্যুতে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আগামী ছ’বছরের মধ্যে শেষ হবে রেললাইন স্থাপনের কাজ। বাৎসরিক এক কোটি যাত্রী পরিষেবার লক্ষ্য নিয়ে দুই রাজধানীর মধ্যে উচ্চ গতির বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করতে চাইছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রস্তাবিত রেল প্রকল্পটি পশ্চিম এশিয়ার ওই দুই দেশে ৩০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এর জন্য ৩,০৬৪ কোটি ডলার বরাদ্দ করতে চলেছে রিয়াদ এবং দোহা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, মাত্র চার বছর আগেও সৌদি ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক ছিল শত্রু ভাবাপন্ন। কিন্তু সেসব ভুলে দুই উপসাগরীয় প্রতিবেশীর কাছাকাছি আসার নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো- ইসরায়েলি আগ্রাসন।
২০১৭ সালে আরব দুনিয়ার চারটি দেশের সঙ্গে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ। ফলে সৌদির পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসরের সঙ্গেও কাতারের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় আকাশ, স্থল এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে দোহার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রিয়াদ। তখন জ্বালানি সমৃদ্ধ আরব দেশটির রফতানি বাণিজ্যের উপর এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল। খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে লম্বা রাস্তার বিমান এবং সামুদ্রিক রাস্তা নিতে হয় কাতারকে।
সৌদির কড়া পদক্ষেপে দোহার রফতানি বাণিজ্য খরচ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। ফলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে দ্রুত রিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাতার প্রশাসন। এ সময় প্রতিবেশী কাতারকে ১৩ দফা দাবি পূরণের শর্ত দেন সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান।
স্বাভাবিকভাবেই দোহা সেটা মেনে নেয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সম্পর্কে চরম অবনতি হয়।
১৩ দফা শর্তের মধ্যে প্রথমেই ছিল কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার কথা, যাকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার দাবি তোলে সৌদি প্রশাসন। পাশাপাশি, দোহাকে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ নামের কট্টরপন্থী ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলে রিয়াদ। সৌদির অভিযোগ, পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশে ‘আরব বসন্ত’-এর নামে উগ্রপন্থী আন্দোলনকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করছে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ।
১৯২৮ সালে মিসরে জন্ম হওয়া ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে নিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় কম জটিলতা তৈরি হয়নি। বর্তমানে বেশ কিছু আরব এবং মুসলিম দেশে নিষিদ্ধ এই সংগঠন। সৌদির অভিযোগ, এই ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে লাগাতার আর্থিক সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে কাতার। আর তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য আল-জাজিরা গণমাধ্যমটিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে দোহা। ফলে রিয়াদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আরব দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ভাবমূর্তিও।
এছাড়া ২০১৭ সালে কাতারের বিরুদ্ধে পর্দার আড়ালে থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আল-নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন এবং আর্থিক সাহায্য দেওয়ার মতো বিস্ফোরক অভিযোগ তোলে সৌদি সরকার। পাশাপাশি, রিয়াদের কট্টর ‘দুশমন’ শিয়া ধর্মাবলম্বী ইরানের সঙ্গে দোহার দহমর-মহরমকেও যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখতেন যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান। আর তাই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশীর উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করেন তিনি। এতে কিছুটা সাফল্যও পায় সৌদি।
রিয়াদের চাপে ২০২০ সালের মধ্যে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করে কাতার। পাশাপাশি আল-নুসরা ফ্রন্টকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দোহা। ফলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রিয়াদের মরু শহর আল-উলায় শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে বিন সালমান প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ককেও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা। যদিও আল-জাজিরা নিয়ে কাতার এখনও নিজের অবস্থানে অটল। দ্বিতীয়ত, এই সময়সীমার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ‘মিত্র’ হয়ে ওঠে দোহা।
সৌদি-কাতার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলেও একে অপরের প্রতি যে অটুট বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, এমনটা নয়। কিন্তু এ বছরের সেপ্টেম্বরে দোহায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নেতাদের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলার পর সম্পূর্ণ বদলে যায় পরিস্থিতি। ইহুদি বিমানবাহিনীর আক্রমণে প্রাণ হারান কমপক্ষে ছয়জন। কাতার ছাড়াও ওই সময় একসঙ্গে আরও পাঁচটি দেশে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেই তালিকায় ছিল- ফিলিস্তিনের গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া।
সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কাতার। বর্তমানে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটির ‘আল-উদেইদ’ বিমানঘাঁটিতে রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ছাউনি। তা সত্ত্বেও দোহায় ইহুদি বিমান হামলার পর স্বাভাবিকভাবেই ওঠে একটি প্রশ্ন। আর সেটি হলো- ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র? না কি তেল আবিবের বিমান হামলার নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন মদত ছিল ওয়াশিংটনের? যদিও এই ইস্যুতে পরে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যুক্তি ছিল, হামলার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেই তা দোহাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু, নানা কারণে সেটা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ট্রাম্পের ওই বিবৃতিতে তেমন সন্তুষ্ট হতে পারেননি আরব নেতারা। তড়িঘড়ি রাশিয়া সফর করেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আরব দেশগুলোর মধ্যে ততক্ষণে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। মন চাইলেই যেকোনও রাষ্ট্রে ঢুকে হামলা চালাবে ইসরায়েল। এ ব্যাপারে স্বার্থ বিঘ্নিত না হওয়ায় ইহুদিদের বারণ করা তো দূরে থাক, উল্টো আড়ালে থেকে তাদের প্রচ্ছন্ন মদত দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
গত সেপ্টেম্বরে দোহায় বিমান হামলার ঘটনাকে ইসরায়েলি ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়ে তার কড়া নিন্দা করে সৌদি আরব। ওই সময় থেকেই রিয়াদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে কাতার। এছাড়া গত জুনে ১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধও তাদের চোখ খুলে দিয়েছে বলে অনেকের অভিমত।
জুনের লড়াইয়ে ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্রে বিমান হামলা চালায় ইহুদি বিমানবাহিনী। সংঘাতের শেষ লগ্নে সেখানে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বিমান বাহিনী। পাশাপাশি, বেছে বেছে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী এবং শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করে ইসরায়েলের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ।
ইরানের শক্তি হ্রাস হতে না হতেই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সেরে ফেলে সৌদি আরব। সংশ্লিষ্ট সমঝোতায় বলা হয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
ইসলামাবাদের পর কাতারের সঙ্গে রেলপথ বিস্তারের চুক্তিকে তাই যুবরাজ সালমানের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলেই মনে হচ্ছে। তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, আরব নিউজ
আমার বার্তা/জেএইচ
