নারীর মুড সুইংয়ের জন্য দায়ী যে বৈজ্ঞানিক কারণগুলো

প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:২২ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান, এন্ডোক্রাইনোলজি এবং মনোবিজ্ঞান বলে- মুড পরিবর্তন একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা; বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে কিছু শারীরবৃত্তীয় ও পরিবেশগত উপাদান এটি আরও দৃশ্যমান করে। 

নারী শরীরের হরমোনের ওঠানামা, ঘুম বা পুষ্টির ঘাটতি, মানসিক চাপ কিংবা আবেগীয় লোড মস্তিষ্কের নিউরোকেমিস্ট্রিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। ফল হিসেবে দেখা দেয় আচরণ, অনুভূতি বা মনোভাবের দ্রুত পরিবর্তন।

স্ট্রেস ও কাজের চাপ

সমসাময়িক নারীর জীবন- চাকরি, পরিবার, সন্তান, সামাজিক প্রতিশ্রুতি- সব মিলিয়ে বহুমাত্রিক দায়িত্বে পরিপূর্ণ। ফলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন, বিশেষত কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। কর্টিসল বাড়লে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে আবেগপ্রবণতা, অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে। পেশাগত ক্ষেত্রে নারীরা প্রায়ই অতিরিক্ত পারফরম্যান্স প্রত্যাশা, কর্মস্থলের প্রতিযোগিতা বা লিঙ্গভিত্তিক চাপের মুখোমুখি হন। দীর্ঘমেয়াদে এই চাপ ‘emotional fatigue’-এর জন্ম দেয়, যা মুড পরিবর্তনকে আরও অনিয়ন্ত্রিত করে তোলে।

হরমোনাল পরিবর্তন

হরমোন- বিশেষত ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও কর্টিসল- নারীর মুড নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে এই হরমোনগুলোর মাত্রা ওঠানামা করে, যা মস্তিষ্কের সেরোটোনিন ও ডোপামিন উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। ফলে এক সময় অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, অন্য সময় মনমরা ভাব, আবার কোনো কোনো দিন বিরক্তিভাব বা অস্থিরতা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থা, প্রসব-পরবর্তী সময় এবং মেনোপজ- এই তিনটি পর্যায়ে হরমোনাল পরিবর্তন আরও বেশি প্রকট হয়। প্রসব-পরবর্তী ডিপ্রেশন বা পেরিমেনোপজাল mood instability এসব পরিবর্তনেরই সম্প্রসারিত রূপ। এন্ডোক্রাইন বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরের এই স্বাভাবিক রূপান্তর মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তা আদান-প্রদানকে অস্থায়ীভাবে পরিবর্তন করে, যা আচরণে প্রতিফলিত হয়।

ঘুমের ঘাটতি

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টার ঘুম নারীর শরীরের জন্য আদর্শ। কিন্তু বাস্তবতা হলো- নারীরা প্রায়ই পরিবার ও কাজের ভারসাম্যে ঘুমে ছাড় দেন। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে লেপ্টিন ও ঘ্রেলিন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়।

এ ছাড়া পিএমএস, গর্ভাবস্থার শেষভাগ, মেনোপজ- এসব পর্যায় ঘুমের ব্যাঘাত আরও বাড়ায়। নিয়মিত ঘুমের অভাব মুড সুইংকে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় রূপ দিতে পারে। 

পুষ্টির ঘাটতি

মুডের স্থিতিশীলতার জন্য মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করতে হয়। কিন্তু আয়রন, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, ওমেগা-৩, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পুষ্টির ঘাটতি হলে সেসব নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হঠাৎ খিটখিটে মেজাজ, মনমরা ভাব, শক্তি কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা দেখা দেয়। যেসব নারী ডায়েটিং, অনিয়মিত খাবার কিংবা কাজের ব্যস্ততায় খাবার বাদ দেন, তাদের শরীরে এই ঘাটতি বেশি দেখা যায়। পুষ্টিবিদদের মতে, খাবারের সময়সূচি, প্রোটিন-কার্বোহাইড্রেট-ফ্যাটের সুষমতা এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার- সবই মুডের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।

মানসিক চাপ ও আবেগ

নারীর মুড পরিবর্তনের অন্যতম বড় কারণ মানসিক চাপ। সমাজ, পরিবার ও কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় নারীর ওপর অঘোষিত ‘দায়িত্ব’ চাপানো থাকে। পরিবারে অসুস্থ সদস্য দেখভাল, গৃহস্থালির পরিকল্পনা, সন্তান লালন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা- এসব দায়িত্ব প্রায়ই নারীদের অদৃশ্য শ্রম হিসেবে গৃহীত হয়। ফলে মানসিক ক্লান্তি তৈরি হয়, যা মুডকে অস্থিতিশীল করে। এ ছাড়া আবেগ সংবরণ বা প্রকাশের সামাজিক বিধিনিষেধ নারীদের আরও চাপে ফেলে। যারা নিয়মিত আবেগ প্রকাশের সুযোগ পান না, তারা অনেক সময় হঠাৎ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। 

নারীর মুড পরিবর্তন কোনো খামখেয়ালি আচরণ নয়; বরং এটি বিজ্ঞানসম্মত, স্বাভাবিক এবং মানবদেহের জটিল কার্যক্রমের অংশ। হরমোনাল ওঠানামা, ঘুম ও পুষ্টির ঘাটতি, চাপ, আবেগ- সব মিলেই নারীর মুড প্রতিদিন ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। সমাজের উচিত এই পরিবর্তনকে বোঝা, সম্মান করা এবং নারীকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়া। একই সঙ্গে নারীদেরও নিজেদের দেহ-মন বুঝে স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকা জরুরি- যাতে মুড পরিবর্তন চাপ নয়, বরং স্বাভাবিক মানবিক অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রতিফলিত হয়।

আমার বার্তা/এল/এমই