ইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে গণহত্যায় লিপ্ত

প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

  মো. জিল্লুর রহমান:

ইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে গণহত্যায় লিপ্তইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে গণহত্যায় লিপ্তগত ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার অজুহাতে প্রায় পাঁচ মাস ধরে গাজা ভূখন্ডের উপর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। ইসরায়েল আত্মরক্ষার নাম করে ফিলিস্তিনের গাজায় যা করছে, তা কোন সাধারণ যুদ্ধ নয় বরং পরিকল্পিত গণহত্যা। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্ব আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ইসরায়েল আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা করছে না। সেখানে শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া, হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে হামলা করে নির্বিচারে হত্যা, খাবার সরবরাহে বাধাদান জাতিগত নিধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গাজার এমন কোন স্থাপনা নেই যা আক্রান্ত হয়নি কিংবা অক্ষত আছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, হামাসের সমস্ত অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পুরো গাজা শহর এবং গাজা উপত্যকার উত্তর অংশে হামলা চালাবে।

বিশ্ববিবেক ও জনমত তাদের নির্বিচার বোমা হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই নেতানিয়াহুর আগ্রাসী বাহিনীকে শর্তহীন গণহত্যায় একনিষ্ঠ সমর্থন ও সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র, কূটনৈতিক সমর্থনসহ জাতিসংঘের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যেতে নিতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। প্রায় পাঁচ মাসের যুদ্ধে ইসরাইলীরা গাজায় অন্তত ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা এবং ৭০ হাজার মানুষকে আহত করেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, নিহত ৩০ হাজারের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১২,৩০০ জন এবং নারীর সংখ্যা ৮,৪০০ জন। গাজার উত্তর ও দক্ষিণাংশে ইসরাইলি বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অন্তত ৩টি পারমানবিক বোমা হামলার সমান বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইউরোপ আমেরিকার প্রায় প্রতিটি বড় শহরে এবং সারা বিশ্বে ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও মার্কিন প্রশাসন জনমতের তোয়াক্কা না করে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার পক্ষে তার শক্ত অবস্থান বার বার নিশ্চিত করছে। দখলদারত্ব অবসানে অবশ্যই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে ও দখল করা ভূমিতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা ধ্বংস করতে হবে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। সম্প্রতি আফ্রিকান ইউনিয়নের একটি শীর্ষ সম্মেলনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন ব্রাজিলের ওই নেতা এবং খবরটি ১৮ ফেব্রুয়ারি  ব্রাজিলের স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে তুর্কি সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, গাজা উপত্যকায় যা চলছে তা কোন সাধারণ যুদ্ধ নয়, এটি একটি ‘গণহত্যা’। গাজায় ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে যা ঘটছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রকৃতপক্ষে জার্মানীর হিটলার ইহুদি নিধনে যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন গাজায় তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। তিনি আরো বলেছেন, এটি যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, এটি বেসামরিক নারী এবং শিশুদের বিরুদ্ধে রণসাজে সজ্জিত একটি বাহিনীর পরিকল্পিত আগ্রাসন। তবে এতে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইহুদীবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টকে অবাঞ্ছিত ঘোষণাসহ নানা রকম বাক্যবাণ ছুঁড়ে চলেছে।

ইহুদীবাদী এ রাষ্ট্রটি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর আস্কারা পেয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। সাম্প্রতিক ইসরায়েলের গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির পক্ষাবলম্বন করেছে এবং এর পশ্চিমা গণমাধ্যম ও মিত্ররাও একই আচরণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের কসাই খ্যাত যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের গাজায় এক নারকীয় গণহত্যায় মেতে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও এতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না। ইউনিসেফ বলছে, প্রতি ১০ মিনিটে অন্তত একটি করে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে। এতে গোটা গাজায় একটু জায়গাও নিরাপদ নেই। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলের টানা বর্বর বোমা হামলায় হাসপাতালগুলোতে লাশের বন্যা হয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলছে, গাজায় হামাসের কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করতে তারা গোটা গাজায় হামলা বিস্তৃত করেছে।

জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু ইসরায়েল বলেছে, হামাসের যোদ্ধারা এসব ভবনের ভেতরে অথবা আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে ইসরায়েলি বাহিনী এসব ভবনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার ৯০৮টি পরিবারকে একেবারে মুছে দিয়েছে অর্থাৎ ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার এই পরিবারগুলোর কোনও সদস্যই আর বেঁচে নেই। শুধু তাই নয় এবার বর্বর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত ১৫ নভেম্বর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে ঢুকে তান্ডব চালিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে! এদের থেকে রক্ষা পায়নি না মুমূর্ষু রোগী, নারী ও নবজাতক শিশু। অবশ্য এ হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্ররোচিত করেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশু মারা যাচ্ছে। সেইসাথে যতো মানুষ আহত হয়েছে তাদের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন শিশু। এদিকে জাতিসংঘের হিসেবে ২১ মাস আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় ৯৭০০ জন বেসামরিক নাগরিক সেখানে মারা গিয়েছে। সে হিসেবে দেখা যায় রাশিয়ায় ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যতজনকে হত্যা করেছে, ইসরায়েল মাত্র এক মাসে তার চাইতেও বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। সব মিলিয়ে গাজার অন্তত ২৩ লাখ মানুষ এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে বর্বরোচিত নারকীয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে সবাই দক্ষিণের পথে পা বাড়ালেও গাজার কোন জায়গায়ই নিরাপদ নয়।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে  একটি শুনানি চলছে। এ শুনানিতে পর্যায়ক্রমে ৫০টির বেশি দেশ ও ৩টি সংগঠনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। অবশ্য এ শুনানির সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে করা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার যোগসূত্র নেই। শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে বলেছে, ফিলিস্তিনের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ইসরায়েলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। শুনানিতে বাংলাদেশ যুক্তিতর্ক তুলে ধরে বলেছে, ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক লোকজনকে হত্যা, তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, খাবার ও পানি সরবরাহে বাধাদান জাতিগত নিধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ওই এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসানে জাতিসংঘের আরও পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের জাতিবিদ্বেষ বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযান আধুনিককালের লজ্জাকর বিপর্যয়ের চরম দৃষ্টান্ত। খাদ্য, পানি, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতি প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় ২৩ লাখ মানুষের ওই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ আনে, কথায় কথায় মানুষকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক দেয়, সেই রাষ্ট্রটি এখন পাখির মতো গুলি করে এবং বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার নিন্দার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তাদের পক্ষে সাফাই গাইছে। জাতিসংঘ উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার কথা বলে প্রাথমিক কার্য সাঙ্গ করেছে। এতে বর্বর ইসরাইলের তেমন কিছু যায় আসে না। সে তার মতো করেই গুলি ও বিমান হামলা অব্যাহত রেখে নিরস্ত্র ও নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এ নির্লিপ্ততা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের ওপর এমন বর্বর হামলা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। এ যুগে এমন বর্বরতা অবিশ্বাস্য বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বেশ কয়েকবার গাজায় স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বিরতির উদ্যোগ নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও ভেটোর কারণে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। আরব লিগ এ ঘটনাকে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যায় ইসরায়েলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। কয়েকদিন আগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে  নির্দেশ দিয়েছে এবং আদালতের আদেশের পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো তা এক মাসের মধ্যে আইসিজেতে জানাতে ইসরায়েলের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও তাতে ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ট মিত্র আমেরিকা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না। ইসরাইল নারী-শিশুসহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশগুলোর প্রশ্রয়ের কারণেই হচ্ছে। পশ্চিমা বেশিরভাগ গণমাধ্যমও একই নীতি অনুসরণ করছে। তাদের সহযোগী ও পুঁথি পড়ানো মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরাইলের বর্বরতা দেখেও না দেখার ভান করছে, তাদের বিবেক বুদ্ধি ও তথাকথিত মানবাধিকারের আসল রূপ এখন উন্মোচিত হচ্ছে! তাদের বিবেক এখন গণহত্যার জয়গানে বিভোর, তথাকথিত মানবাধিকারের বয়ান তাদের কাছে বুলি আওড়ান পুঁথি ছাড়া আর কিছুই নয়!!


লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

আমার বার্তা/মো. জিল্লুর রহমান/এমই