অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি, বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫২ | অনলাইন সংস্করণ

  মো. জিল্লুর রহমান:

একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তন ও এর মোকাবেলা করা। দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জনজীবন ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় তা আমাদের ব্যাপক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণাও চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়া আরও চরম হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, মানব বসতি এবং সমাজের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। মানুষের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী।

সাধারণত এপ্রিল আমাদের দেশের উষ্ণতম মাস। এ মাসে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ১৯ এপ্রিল ২০২৪ চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটি এ বছরের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে তখন তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। গত বছরের ১৭ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা হয়েছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল গতবারের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তার আগে ১৯৯৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল।

সাধারণত কোনো এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে গণ্য করা হয়। বর্তমানে খুলনা বিভাগের পাশাপাশি রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও পাবনা জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের আরও নানা স্থানে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ প্রবাহমান। রাজধানী ঢাকায়ও বয়ে যাচ্ছে মাঝারি তাপপ্রবাহ। এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী তিন দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা কম; বরং এটি বাড়তে পারে। আসলে এপ্রিল মাসজুড়েই তাপপ্রবাহ থাকবে। তবে সময়ভেদে এর মাত্রা কমবেশি হতে পারে। পাশাপাশি জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিও বাড়তে পারে। এ মাসে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেননি আবহাওয়া অফিস।

ভূ-পৃষ্ঠের কোনো স্থানের ২৫-৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে ওই স্থানের জলবায়ু বলা হয়। এটি মূলত কোনো স্থানের দীর্ঘদিনের বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, রৌদ্রালোক ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া যেমন সৌর বিকিরণের মাত্রা, অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন, সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদি নানা কারণে জলবায়ু স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হলেও মূলত মানবসৃষ্ট কারণ যেমন কলকারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস, কয়লা পোড়ানো, ইটভাটার ধোঁয়া, গাছ কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলপ্রবাহে বাঁধা ইত্যাদি বহু কারণেই জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

অতিসম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের নজির দেখা গেছে। বৃষ্টিপাত এত বেশি হয়েছে যে পথঘাট ডুবে গাড়ি ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি শপিংমলও তলিয়ে গেছে। কোথাও মহাসড়ক ভেঙে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে উড়োজাহাজের যাত্রা বাতিলের পাশাপাশি মেট্রো স্টেশনের কার্যক্রমও থেমে গেছে। ১৯৪৯ সালের পর থেকে এমন বৃষ্টিপাত দেখেনি মরুভূমির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানুষ। অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট হওয়া বন্যায় দুবাইয়ের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। অফিস ও বাড়িতে আটকা পড়েছে বেশিরভাগ মানুষ। রেকর্ড বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে ডুবে যায়। আকস্মিক বন্যায় দুবাই শহরে স্থবিরতা দেখা দেয়। অস্বাভাবিক ঝড়বৃষ্টির ফলে হঠাৎ বন্যার কবলে পড়েছে দেশটি। পানির নিচে তলিয়ে গেছে দুবাই বিমানবন্দরের রানওয়ে। এর ফলে বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বেশিরভাগ ফ্লাইট বাতিল, পরিবর্তন ও বিলম্ব করা হয়। শারজাহ ও দুবাইয়ের বিভিন্ন এলাকার আবাসিক ভবনেও পানি ঢুকেছে। এতে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দেশজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে শহরে বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

মরুভূমির দেশ আরব আমিরাতে ভারী বৃষ্টিপতের ঘটনা খুবই ব্যতিক্রম। দেশটির ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি বলছে, একদিনের হিসাবেই ৫০টিরও বেশি আবহাওয়া স্টেশন ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে চারটি স্টেশন রেকর্ড করেছে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত। অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের ক্লাইমেট চেঞ্জ নলেজ পোর্টালের তথ্য বলছে, আরব আমিরাতে বছরে গড়ে ১৪০ থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটির আল আইন শহরের খাতম আল শাকলা এলাকায় ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে ২৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া কর্তৃপক্ষ। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বছরে গড়ে ৯৪.৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টাতেই দুবাইয়ে ১৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানব সৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তীব্র বৃষ্টিপাতসহ বিশ্বজুড়ে আরও চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং পরবর্তীতে আরও বাড়বে। আবার কিছু কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তন এই বিধ্বংসী বৃষ্টি ও বন্যার কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিক আবহাওয়া ব্যবস্থার মধ্যেও বিপুল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ছিল। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে আগের চেয়ে ঘনঘন সামুদ্রিক ঝড় হচ্ছে। পৃথিবীর শুকনো অঞ্চলগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা হচ্ছে। আর আর্দ্র অঞ্চলগুলো হয়ে পড়ছে আগের চেয়ে শুকনো। এ ধরনের পরিবর্তনগুলোকে এক কথায় বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফস্তর বা হিমালয়-আল্পসের মতো পর্বতমালার হিমবাহ অথবা সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল খণ্ডগুলো গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় নিচু এলাকাগুলো নোনাপানির নিচে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ হারাচ্ছে তার বাসস্থান, কৃষিজমি ও নিরাপত্তা।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো তাপদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির ২০১৪ সালের মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো উঠে আসে৷ ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ ক্রমাগত বাড়ছে৷ একইভাবে, উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ গলতে থাকায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্রাণঘাতী দুর্যোগ ঝুঁকি আরও বাড়ার শঙ্কা আছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততাকে প্রধান প্রাকৃতিক বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মূল লক্ষ্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থসহায়তা দেওয়া। ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় হার দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বা সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখতে বিশ্বের দেশগুলো একমত হয় এবং সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সমাজের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটি স্বাস্থ্য, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, খাদ্য, বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো প্রায়ই আন্তঃসম্পর্কিত। এগুলো একে অপরকে এবং বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে কয়েকটি অঞ্চল হয়তো এতটাই গরম হয়ে যেতে পারে যে তা মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। জলবায়ু সম্পর্কিত পরিবর্তন বা দুর্যোগের কারণে কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ তাদেব দেশের অন্য অংশে পাড়ি জমাতে বা অন্য দেশে অভিবাসী হতে বাধ্য হবে।

গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে কিছু বিজ্ঞানী "জলবায়ু জরুরি অবস্থা" বা "জলবায়ু সংকট" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিছু গবেষক এবং কর্মী এগুলোকে সভ্যতার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি বলে চিহ্নিত দিয়েছেন। গবেষকরা বলছেন, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল মারাত্মকভাবে গরম হয়ে উঠতে পারে, সেসব স্থানে বসবাস অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। অথবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি এবং এই বিপর্যয় মোকাবেলায় ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না গ্রহণ করি, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। অন্যথায় অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি, বন্যা, খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাবগুলো আরও প্রকট হবে।

 

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।


আমার বার্তা/মো. জিল্লুর রহমান/এমই