সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য নিরসন
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:০০ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫(ঘ)এ সমাজের অসহায় মানুষের জন্য সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে সামাজিক নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দারিদ্র্য নিরসনমূলক বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহনের ফলে দারিদ্র্য বিমোচন,কর্মসংস্থান ও অন্যান্য খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে-দেশে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ৩১.৫ ও ১৭.৬ শতাংশ হতে ২০২২ সালে যথাক্রমে ১৮.৭ ও ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সাফল্যের মূলে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি সহায়ক নীতি ও কৌশল এবং ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। দারিদ্র্য বিমোচন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে।
স্মার্ট সামাজিক সুরক্ষা: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগীদের ইলেকট্রনিক উপায়ে গভর্ণমেন্ট টু পার্সন ব্যবস্থায় ভাতা বিতরণ কার্যক্রম ১৪ জানুয়ারি ২০২১ প্রধানমন্ত্রী উদ্ভোধন করেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট এক কোটি ১৫ লক্ষ ৩১ হাজাার ৫৬৭ জনকে জিটুপি পদ্ধতিতে ভাতা বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া দেশব্যাপী প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। শনাক্তকৃত প্রায় ৩৩.৩৪ লক্ষ প্রতিবন্ধীর তথ্য সম্বলিত ”ডিজএবেলিটি ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম” নামক নতুন সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এই সফটওয়্যারে উপাত্ত সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে ডাটাবেজ সার্ভার স্থাপন করা হয়েছে। সর্বমোট ১১৫ টি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ৩৪ টি ক্যাশভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে ১৯টি কর্মসূচির অর্থ জিটুপি পদ্ধতিতে সরাসরি উপকারভোগীদের ব্যাংক হিসাব/মোবাইল ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হচ্ছে।বর্তমানে ৯৩ শতাংশের অধিক ক্যাশভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা জিটুপি পদ্ধতিতে প্রদান করা হচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বেসরকারি এতিমখানায় সমাজের এতিম ও সুবিধা –বঞ্চিত শিশুদের মাথাপিছু অনুদান (ক্যাপিটেশন গ্রান্ট) প্রদান করে আসছে। বর্তমানে বেসরকারি এতিমখানায় স্মার্ট সিস্টেম (জি ২১) পদ্ধতিতে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রদানের লক্ষ্যে পাইলটিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪ জেলায় (ঢাকা, নারায়নগঞ্জ,নরসিংদী এবং গাজীপুর) পাইলটিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ৬৪টি জেলায় পাইলটিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে ।
প্রতিবন্ধী সুরক্ষা কার্যক্রম: প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ এবং অধিকার সুরক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আগামী অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাপ্রাপ্তের সংখ্যা বর্তমান ২৯ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি করে ৩২ লক্ষ ৩৪ হাজার জনে উন্নীত করা হবে।এছাড়া,প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তির হার বিদ্যমান ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫০ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর ২০২৩ মহান জাতীয় সংসদে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন ২০২৩’পাশ করা হয়েছে।জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ঢাকার মিরপুরের ১৪ নং সেক্টরে ১৫ তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক জাতীয় প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে এবং ফাউন্ডেশেেনর ক্যাম্পাসে ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ বাংলা ইশারা ভাষা দিবস সরকারি ভাবে উদযাপন করা হয়েছে।দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে থেরাপিউটিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবাও সাহায্যকেন্দ্র চালু রয়েছে। এ সকল কেন্দ্র হতে বিনামূল্যে সেবা এবং সহায়ক উপকরণ প্রদান করা হচ্ছে। এ সকল কেন্দ্র হতে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ৭৫ হাজার সহায়ক উপকণ কৃত্রিম অঙ্গ,হুইল চেয়ার, সাইকেল ক্রাচ,স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, ওয়াকিং ফ্রেম, সাদা চড়ি, এলবো ক্রাচ, আয়বর্ধক উপকরণ হিসেবে সেলাই মেশিন)প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে অনুদান/ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ফাউন্ডেশনের কল্যাণ তহবিল থেকে ২০০৩-০৪ হতে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিব›ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার মাঝে প্রায় ১৬ কোটি টাকা অনুদান ও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের উপকারভোগী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার।
মা ও শিশু সহায়তা কার্যক্রম: গ্রামীণ এলাকার মাতৃত্বকালীন ভাতা ও শহর এলাকার কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচিকে ঢেলে সাজিয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল কর্মসূচির আওতায় এম আইএস ভিত্তিক মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ কর্মসূচির অধীনে মায়েদের ৩৬ মাস পর্যন্ত মাসিক ৮০০টাকা প্রদান করা হয়।সারাদেশে মা ও শিশুদের সহায়তা প্রাপ্তি সহজ ও নিশ্চিত করতে অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। এছাড়া, এ কার্যক্রমের আওতা আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৫ লক্ষ ৪ হাজার ৮০০ জন হতে ১৬ লক্ষ ৫৫ হাজার ২৮০ জনে উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
সুবিধা বঞ্চিত ও বিপন্ন সকল শিশুর সুরক্ষায় শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে সমগ্র দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।বর্তমানে গাজীপুর, চট্টগাম, রাজশাহী, খুলনা,রংপুর, বরিশাল,সিলেট ,ফরিদপুর ,কুষ্টিয়া, বরগুণা ,কক্সবাজার ,জামালপুর শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত বিপন্ন শিশুদের পরিবার বা নিকট আত্মীয় বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পুনঃএকত্রীকরণ/পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হচ্ছে।বর্তমানে এ সকল কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৮ জন ছেলে এবং ১ হাজার ২১৬ জন মেয়ে শিশু অবস্থান করছে।
বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের সুরক্ষা: দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে।২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লক্ষ ১ হাজার প্রবীণের জন্য মাসিক ৬০০ টাকা হারে মোট ৪ হাজার ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।আগামী অর্থবছরে ভাতাপ্রাপ্ত প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধিকরে ৬০ লক্ষ ১ হাজার জনে উন্নীত করা হবে এবং এ বাবদ ৪ ৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।এছাড়া ভাতাপ্রাপ্ত বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলার সংখ্যা বিদ্যমান ২৫ লক্ষ ৭৫ হাজার জন থেকে বৃদ্ধি করে ২৭ লক্ষ ৭৫ হাজার জনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এ বাবদ ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বেদে, হিজরা ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা: বেদে,হিজরাসহ সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বর্তমানে মোট ৬ হাজার ৮৮০ জনকে ভাতা দেয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে মোট১২ হাজার ৬২৯ জনকে ভাতার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া, বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা প্রদান কার্যক্রম চলমান থাকবে।আগামী অর্থবছরে সমাজের অনগ্রসর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ৯০ হাজার ৮৩২ জনকে ভাতার আওতায় আনা হবে। হিজরা, বেদেসহ সকল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা উপবৃত্তি চলমান থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : মহান মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যানে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যানে তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে সকলশ্রেণির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানি ভাতা ২০২১-২২ অর্থবছরে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া শহিদ খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা জি-টু-পি প্রক্রিয়ায় সরাসরি ভাতাভোগীর ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা হচ্ছে।বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতাসহ উৎসব ভাতা,বাংলা নববর্ষ ভাতা,জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মহান বিজয় দিবস ভাতা, চিকিৎসা সেবা,দাফন বাবদ অনুদান প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে।এছাড়া সমন্বিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি নিশ্চিতকল্পে তাঁদের অনুক’লে স্মার্ট কার্ড ও ডিজিটাল সনদপত্র প্রদানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ হাজার বীর নিবাস নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কবি।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই