সংকটকালীন বাংলাদেশ: একতার অভাবে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১২ | অনলাইন সংস্করণ

  রহমান মৃধা:

বাংলাদেশের স্বৈরশাসনকালীন সময়ে দেশের কার্যক্রম একজন নেতার নির্দেশনায় পরিচালিত হতো। ন্যায়-অন্যায় যাই হোক, শেখ হাসিনার কথাই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু ১৬ বছর পর, দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান “বটমলেস বাস্কেট” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন, কিন্তু জাতির মধ্যে ধৈর্যের অভাব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য, তবে রাজনৈতিক বিভাজন ও নেতৃত্বের অক্ষমতা একত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সরকার পরিবর্তনের সময় আমরা ভুলে গেছি যে, দেশের উন্নয়ন বা সংস্কার একক কোনো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নয়; এটি সমগ্র জাতির দায়িত্ব। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করছে, কিন্তু অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? তাদের ভূমিকা কি শুধু ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য, নাকি সংস্কারের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে তারা আগ্রহী? বিএনপির মতো দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত— তারা কি শুধুমাত্র ক্ষমতায় ফেরার জন্য কাজ করছে, নাকি বাস্তবিক কোনো সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?

একটি পরিবার কীভাবে সম্পদের লুটপাট করতে পেরেছে এবং সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি সত্ত্বেও নিরাপদে দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছে, এটি গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। তথ্য অনুসারে, বিএনপি ও প্রশাসনের কিছু সদস্য শেখ পরিবারের অপরাধীদের পালাতে সাহায্য করেছে। তাদের সহযোগীদের নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি।

দেশে পেঁয়াজ ও ডিমের মতো সাধারণ পণ্যের অপ্রত্যাশিত সংকট পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার একটি প্রমাণ। বাংলাদেশ, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে ফসল ফলানো সম্ভব, সেখানে এ ধরনের সংকট শুধুমাত্র দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফল। দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে উন্নয়ন বা সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোলা থাকবে না। এমনকি রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব দিলে হয়তো তারা এতটা ক্ষতি করত না, যেমনটা দেশের নাগরিকরা করছে।

শুধু শেখ পরিবারের অপরাধের বিচার করলেই হবে না; যারা তাদের পালাতে সাহায্য করেছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। অপরাধীদের পালাতে দেওয়া বা ক্ষমা করা দেশের ভবিষ্যৎকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সংকটগুলো—রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি—জাতির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংঘাত গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ও উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষত ২০২৪ সালের শেষদিকে সহিংসতায় বহু প্রাণহানির কারণে। এই অবস্থায় দেশটি ক্রমশ একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনও দেশের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি ও কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও বৈশ্বিক নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান সামান্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশটির ওপর ব্যাপকভাবে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে, দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট ও রাজনৈতিক বিভাজন সংস্কার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। আন্তর্জাতিক মহলও আশঙ্কা করছে, সংকট সমাধান না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় দেশটি অক্ষম হবে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি পুরনো ও গভীর সমস্যা, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। দুর্নীতি রোধ ও অর্থ পাচার ঠেকানোর জন্য সরকারের শক্তিশালী পদক্ষেপ প্রয়োজন, তবে প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর প্যাসিভ ভূমিকা এবং কূটনীতিকদের নিষ্ক্রিয়তা এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে।

দুর্নীতির ধরণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

১.    হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার: অবৈধ অর্থ লেনদেনের এই পদ্ধতি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এড়িয়ে অর্থ পাচারের একটি বড় মাধ্যম। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে।
২.    সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি: বড় প্রকল্পে তহবিলের অপব্যবহার ও ঘুষ নেওয়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটে, যা অর্থ পাচারের পথ খুলে দেয়।

সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসনের প্যাসিভ ভূমিকা: সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসন দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু তাদের প্যাসিভ বা নিস্ক্রিয় ভূমিকা সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে। প্রশাসন প্রায়ই দুর্নীতির তদন্তে সঠিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অংশ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে এই সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হচ্ছে।

কূটনৈতিকদের নিষ্ক্রিয়তা: কূটনীতিকরা দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা ও নিষ্ক্রিয়তা অর্থ ফেরত আনার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে।

সমাধানের পথ:

দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

১.    দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সঠিক ব্যবহার: দুদককে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
২.    বৈদেশিক লেনদেনের ওপর কড়াকড়ি: হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ওপর আরও শক্ত নজরদারি প্রয়োজন।
৩.    প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ: দুর্নীতি দমনে সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
৪.    কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা: পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা জরুরি।
৫.    অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন ইউনিট: আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভ্যন্তরে দুর্নীতি দমন ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

এই কাঠামো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে, দুর্নীতির বিস্তার এবং অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত হবে এবং জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

যদি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাবের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে অভিযোগ না করে নিজেদের দলের ভেতর সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া। প্রতিটি দলের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত, চাঁদাবাজ ও অপরাধীরা অবস্থান করছে; তাদের সঠিক পথে আনতে ব্যর্থ হলে দলগুলো ভবিষ্যতে দেশের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে। এখনই সময় দলমত নির্বিশেষে একসঙ্গে কাজ করার, নাহলে দেশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।

সবশেষে দেশে “সাকিবিয়ান” নামে একটি চক্র ক্রিকেটকে ব্যবহার করে একটি ভয়ঙ্কর চক্রান্ত তৈরি করছে। এই চক্রান্তের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা, যা স্বৈরশাসক গোস্টির একটি পরিকল্পনার অংশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত সাকিবকে দেশে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকা। একইসাথে, অন্তবর্তীকালীন সরকার জনগণের সমালোচনা করার সুযোগ দেওয়ার যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে commendable। তবে, দুর্নীতিবাজ কিছু ব্যক্তি এই বাকস্বাধীনতাকে ভুলভাবে ব্যবহার করে দেশের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সমালোচনা যদি সৃজনশীলতা বজায় না রেখে করা হয়, তবে তা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সেদিকে আমি আশা করি, অন্তবর্তীকালীন সরকার সজাগ থাকবে।


লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।



আমার বার্তা/জেএইচ