প্রয়োজন একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৯ | অনলাইন সংস্করণ

  এস এম আজাদ হোসেন:

দেশের সড়ক যেন এক মৃত্যু ফাঁদ। পরিবারের কাছ থেকে সকালে হাসি মুখে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছেন যিনি হয়তো ফিরছেন লাশ হয়ে। কোথাও কোন নিয়মের বালাই নেই যেন।যে যেমন পারছে সে তেমন করে সড়ক ব্যবহার করছে।যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি নিয়ম মানছেন না।যিনি গাড়ি ব্যবহার করছেন তিনিও নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না।যিনি পথচারি তিনি জানেনই না সড়ক ব্যবহার বিধি।এ যেন ‘আল্লাহর নামে চলিলাম বা আল্লাহর নামে পথে নামিলাম’ অবস্থা। 

সড়কের বিশৃঙ্খলা রোধে উদ্যোগ যে নেয়া হচ্ছে না তা কিন্তু নয়।তাহলে কাজ হচ্ছে না কেন?উত্তর হল সমন্বয়হীনতা।সরকারের সড়ক সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা মন্ত্রণালয়গুলির মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট।নেই কোন সমন্বিত উদ্যোগ।রোডক্রাশ রোধে,যানজট নিরসনে,সড়কে শৃংখলা ফেরাতে সভা,সেমিনার,সিম্পোজিয়াম হচ্ছে,প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে,অর্থ ব্যয় হচ্ছে কিন্তু আসল কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।এর কারণ সেই সমন্বয়হীনতা।২/৩/৫ বছরের প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগছে ৫/৭/১০ বছর।ততদিনে প্রকল্পের উপযোগিতা শেষ।কিন্তু প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ৩গুণ-৪গুণ হয়ে যাচ্ছে আর সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ।এর কারণ সেই সমন্বয়হীনতা। 

পৃথিবীর যেসব দেশে সড়ক নিরাপদ রাখার জন্য কোনো আচরণবিধি বা কোড নেই, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।এ ধরনের আচরণবিধি পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশেই রয়েছে এবং দেশের প্রতিটা নাগরিক তা যথাযথভাবে মেনেও চলেন।নিরাপদ সড়ক আচরণবিধি বলতে বোঝায় এটা হলো হচ্ছে সেই ডকুমেন্ট,যেখানে কোন্ আইনের কোন্ ধারা লঙ্ঘনে কী ধরনের দণ্ড রয়েছে তা উল্লেখ করাসহ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনের চালক, হেলপার,যাত্রী,পথচারী,ট্রাফিকপুলিশসহ সব ধরনের রাস্তা ব্যবহারকারী কোন্ পরিস্থিতিতে কী ধরনের আচরণ করবে তা বর্ণিত থাকে।কীভাবে জনসাধারণের মাঝে প্রচারণার মাধ্যমে এই আচরণবিধি জনপ্রিয় করে তুলতে হবে,প্রচারণার দায়িত্বে কারা থাকবে,কীভাবে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে,গাড়িচালনা শেখার স্কুলগুলোতে কীভাবে বাধ্যতামূলক পাঠ্য করতে হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সেখানে সময়ানুগ এবং সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে মনে হয় এখনো সেই আদিম অবস্থায় রয়ে গেছে। কোনো দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা—এ দুই বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এছাড়া উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা ও কাজ শুরু করতে হবে এখনই।

দেশে যান চলাচলের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বড় অংশীদার বিআরটিএ। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও সংস্থাটির চেয়ারম্যান। কিন্তু নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে সারা বছর তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে কিছু পোস্টার-লিফলেট বিতরণ, সভা সেমিনার করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু চালকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন,তাদের রোড সেফটি উইংয়ের বাৎসরিক বাজেট খুবই কম। এর একটা অংশ চলে যায় বৈঠক আপ্যায়নে। বাকিটা পোস্টার ছাপিয়ে ব্যয় করা হয়।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলেও নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মনোযোগ নেই তাদের, বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর চার লেন সড়ক, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর। সড়ক আইন বাস্তবায়ন, পথচারী পারাপার নিশ্চিত করা, চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা, যানবাহনের গতিনিয়ন্ত্রণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন খুব একটা হয় না।

উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি নির্দেশকও বটে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হতে চাওয়া বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এখনো বিশৃঙ্খলই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। সাজা ও জরিমানার পরিমাণ যা-ই নির্ধারণ হোক না কেন, তা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ বাস্তবায়ন না হলে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থেকেও কোনো লাভ হবে না। পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এলে এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা গেলে দুর্ঘটনার পরিমাণ এমনিতেই কমে আসবে, যেমন কমে এসেছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়।

বাংলাদেশে সড়কে দুর্ঘটনা ও যানজট নিত্যদিনের চিত্র। সড়কে বছরে এত প্রাণ যায় যে যুদ্ধরত অনেক দেশেও এতজনের প্রাণহানি হয় না। বিভিন্ন খাতে আমরা বেশ উন্নয়ন করতে পারলেও স্বাধীনতার পর থেকেই অব্যবস্থাপনা ও সড়কে মৃত্যু যেন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার নিত্যসঙ্গী। গত কয়েক বছরে সড়কে প্রাণহানির পরিমাণ আরো বেড়েছে।পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীর বিদায়ে অনেক পরিবারকে পথে নামতে হচ্ছে। চালকের পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ আছে কিনা, তার লাইসেন্স আছে কিনা তা দেখা দরকার। সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে বলে গাড়ি চালানো, যাত্রীদের সঙ্গে বচসায় জড়ানো, অন্য বাসকে টেক্কা দিতে মহাসড়কে রেস লাগানো—এ যেন বাসযাত্রার নিত্যচিত্র। বাস চালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সঠিক লোক বাছাইয়ের যথাযথ প্রক্রিয়া আছে কিনা কিংবা থাকলে তা মান্য করা হয় কিনা তা স্পষ্ট নয়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা একেবারে বন্ধ করতে না পারলেও সড়কে অহেতুক মৃত্যু অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সেদিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুনজর আছে বলে মনে হয় না। তা না হলে প্রতি বছর সড়কে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলত না। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী আন্দোলনের ফলে তৎকালীন সরকার ‘সড়ক পরিবহন আইন -২০১৮’নামে একটি আইন পাস করলেও আইনটি আজো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এবং আইনটিতে সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত।নতুন বাংলাদেশ ‘সড়ক নিরাপত্তা’আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী। 

২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২৪।প্রতিবছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসকে সামনে রেখে একটি প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয়। প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয় এজন্য যে,সড়ক নিরাপত্তা ও সড়কে শৃংখলা ফেরাতে অনুঘটক হিসেবে প্রতিপাদ্যটির অন্তর্নিহিত তাতপর্যকে কাজে লাগানো।অতীতে বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে সেরকম ঘটেছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি।এবারের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘ছাত্র জনতার অঙ্গীকার,নিরাপদ সড়ক হোক সবার’।এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি এসেছে।সম্প্রতি ৫ আগস্ট দেশে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে।নতুন আশায় নতুন বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয়েছে।দেশের অন্যান্য সেক্টরের মত সড়কে বিগত ৫৩ বছরের পুঞ্জিভুত জঞ্জাল সরিয়ে সুশৃংখলময় এক নতুন বাংলাদেশ সড়ক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে।আমাদের প্রয়োজন একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা যে তার সম্মোহনি সূরের মুর্চ্ছনায় সকল বাধা পেরিয়ে এদেশের সড়ককে নিরাপদ করে দেবে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।

 

লেখক : সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মহাসচিব, নিরাপদ সড়ক চাই।