সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:১৫ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। পৃথিবীতে এ যাবৎ মানব কল্যাণে সৃষ্টি, যা কিছু সুন্দর অবদান, চিরঅম্লান থাকবে তার অর্ধেক কৃতিত্ব নারীদের এবং বাকী অর্ধেক পুরুষদের। নারী এবং পুরুষ যেন একে অপরের পোষাকস্বরুপ, যেন নারী ও পুরুষ পরস্পরবিহীন অপূর্ণ। নারী একাধারে কন্যা, জায়া, জননী।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র এবং জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহন ও নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে শুরু হয় নারী উন্নয়নের প্রাতিষ্ঠানিক অভিযাত্রা। সরকার জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ, বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনসহ সকল আন্তর্জাতিক সনদ অনুসরণে কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্তকরণকে শক্তিশালী অনুঘটক এবং বহুমাত্রিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা আনয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, টিকা প্রদানের কভারেজ বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধসহ দারিদ্র হ্রাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। গ্লোবাল জেন্ডার গেপ রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী বিশে^ জেন্ডার বৈষম্য সূচকে ১৪৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৯ তম অবস্থান অর্জন করেছে। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সুবিধা বঞ্চিত মহিলাদের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স¦াস্থ্য,কৃষি,ব্যবসা,জেন্ডার ও আইনী সহায়তাসহ দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সহায়তা সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। তথ্য আপা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ই-কমার্স মার্কেট প্লেস ”লাল-সবুজ ডট কম” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারীরা এ প্ল্যাটফর্মে তাদের উৎপাদিত ও সংগৃহীত পণ্য বিক্রয় করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৪ হাজার ৫০০ জন উদ্যোক্তা এ প্লাটফর্মে নিবন্ধন করে পণ্য বিক্রয় করছেন। একই সাথে আইসিটি ভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের আত্মকর্মসস্থানের ব্যবস্থা ও উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের টেকসই ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য ”হার পাওয়ার” প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া জয়িতা ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরী ও তাদের দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। গ্রামীণ দুস্থ ও অসহায় মহিলাদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ক্ষুদ্র্ ঋণ তহবিল কার্যক্রম চলমান রয়েছে।প্রাপ্ত বরাদ্দ দ্বারা ঘূর্ণায়মান আকারে ৬৪টি জেলার ৪৮৮টি উপজেলায় মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নারী পুনর্বাসন বোর্ড ও জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ২০১১ সালে জয়িতা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাকরাসহ, মহিলা হোস্টেল নির্মাণ,নারী উদ্যেক্তা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহনসহ আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সরকারের অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগসমূহ। একই সাথে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন-২০১৫ প্রণয়নকরাসহ পাসপোর্টে মায়ের নাম অর্ন্তভুক্ত করাও সরকারের অপর একটি উদ্যোগ। সরকারের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপি ১২৯৫৬টি পল্লী মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যত্নসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা ও সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণপ্রদান করা। আরো রয়েছে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে ৬ মাসে উন্নীতকরন এবং দরিদ্র্য ও গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান। সরকারি কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সেনসিটিভ বাজেট প্রদান করা হয়েছে। জেলা ভিত্তিক মহিলা কম্পিটার প্রশিক্ষন প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ১৩৪৩২ জন শিক্ষিত বেকার নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করাও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের অংশ।
নারীর দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্বির লক্ষ্যে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ লাখ নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়া ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১১ হাজার কোটি টাকার ঋন বিতরণ করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে আত্মকর্মসংস্থান কার্যক্রম (আইজিপি)- এর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেডব্যাংক তৈরি করা হয়েছে। ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট -এর আওতায় প্রতিবছর ১০ লাখ উপকারভোগীকে ২৪ মাসের জন্য ৩০ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়েছে। শহরাঞ্চলে কর্মজীবি ল্যকটেটিং ভাতার আওতায় মাসিক মাথাপিছু ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋন তহবিলের আওতায় দেশের ৪৮৮টি উপজেলায় ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০৯ কোটি টাকা অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের মাঝে বিতরন করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে নারী কর্মকর্তার হার ২০২০ সাল নাগাদ শতকরা ২৫ ভাগে উন্নীত করা হয়েছে। ২০ থেকে ২৪ বছরের নারীদের স্বাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আওতায় অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের সহযোগিতা করা হয়। গ্রামীন নারীদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। সরকার পল্লী এলাকার নারীদের ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি প্রদান এবং স্বনির্ভর হওয়ার জন্য পল্লী মাতৃকেন্দ্র কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলায় ১৪ হাজার ৮ শত ৬টি গ্রামে মাতৃকেন্দ্র গঠন করে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৫শত ৬ জন গ্রামীণ দুঃস্থ নারীকে মাতৃকেন্দ্রের সদস্য হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৯ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫শত ৫৬ জন বিভিন্ন পেশায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত ১৪১ কোটি ৮৮ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
নারী সমাজের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে গত এক যুগে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। নারীর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে পারিবারিক সহিংসতা দমন ও নিরাপত্তা আইন ২০১২, মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রন আইন ২০১২, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন ২০১১, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭, শিশু আইন ২০১৩, হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ প্রণনয়নসহ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বিভাগীয় পর্যায়ে One stop crisis center খোলা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ ও পরীক্ষার বহুল সমালোচিত ও অবমাননাকর Two fingers text. .
সংসদে নারী আসনের সংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ও প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নারী জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন। বর্তমান অনÍর্বর্তীকালীন সরকারে দুইজন নারী উপদেষ্টা(মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন) রয়েছেন। এ ছাড়া ও একে একে দেশ পেয়েছে নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী সংসদ উপনেতা, স্পীকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, জাতিসংঘসহ বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে নারী রাষ্ট্রদূত, নারী উপাচার্য থেকে শুরু করে রাজনীতি, প্রশাসনে নারী সচিব, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব। প্রথম নারী পর্বতারোহী, বিজি এমই এর প্রথম নারী সভাপতি, এবং প্রথম নারী মেজর জেনারেলসহ অসংখ্য নারী গত এক যুগে বিশ্বজুড়ে আলোচিত ও উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও সফলতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জলতর হচ্ছে। এ সকল প্রাপ্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্মাননাসমূহ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এ বিরল সম্মান দেশ ও জাতির জন্য গৌরবজনক। কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সরবরাহ চেইনসহ অন্যান্য বৃহৎ কর্মক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকসহ নারীকর্মীদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি মেয়ের কাছ থেকে বিশ্ব যেন উপকৃত হতে পারে। নারীদের এ সম্ভাবনা ইতিমধ্যে উপলব্ধি করা গেছে। প্রতিটি নারীর অবিকশিত মেধা কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই বিকাশ ঘটানো সম্ভব। আয় এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই ক্ষমতায়ন বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন সম্ভব। তাই আয় বর্ধক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়, ঢাকা।
আমার বার্তা/এমই