জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংস্কার করতে হবে

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার:

দেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে রাষ্ট্র সংস্কার অপরিহার্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে জনসাধারণের মধ্যে। অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশনও ঘোষণা করেছে। কমিশন ইতোমধ্যে তাদের কাজও শুরু করেছে। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন এর মধ্যে অন্যতম।এ ছাড়াও সংস্কারের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহল অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার নিশ্চিত করতে জোরালো তাগিদ দিয়েছে। এ নিয়ে সম্প্রতি মার্কিন সিনেটররা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রবল দাবি ওঠে। সেই সঙ্গে সংস্কারের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা শুরু হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজও একমত পোষণ করেছে। যদিও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার একটি জটিল ও কঠিন কাজ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেহেতু দেশের সব পক্ষই একমত। জনগণও রাষ্ট্র সংস্কার প্রত্যাশা করে। আন্তর্জাতিকভাবেও এর একটা তাগিদ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরির জন্য একটি পথরেখা ঘোষণা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সার্বিক সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে। এর মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের বার্তা বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণ তাগিদের ঐক্য বন্ধনে গোটা জাতিকে শক্তিশালী ও আশাবাদী করে তুলবে।দেশে এর আগেকার অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর যে অভিজ্ঞতা, সেগুলো থেকে এখনকারটি একটু ভিন্ন ছিল।

এখানে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর এ সরকার এসেছে। ড.মুহাম্মদ ইউনূস এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রায় সবার কাছেই অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য মানুষ। সবাই তাকে পছন্দ করে। তার ওপর মানুষের আস্থা আছে। রাজনীতিতে তিনি সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু অর্থনীতি ও মানুষের জন্য তার যে কর্মকাণ্ড, সেটিই তাকে সমগ্র বিশ্বে এবং এ জায়গাটায় গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এক দুই মাসে একটি সরকার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা কঠিন। কিন্তু এখানে যারা সদস্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগই সরকারি কাজে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব বেশি অভিজ্ঞ নন। কয়েকজন আছেন, যাদের অভিজ্ঞতা আছে। কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, আমলা ও এনজিও-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আছেন, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং তাদের কাছ থেকে রাতারাতি সবকিছু পেয়ে যাব, সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে অতিসম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কী করতে চান, তার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী, ভিশন কী-সেগুলো তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে সংস্কারের জন্য যে কমিশন তিনি গঠন করেছেন, সেগুলো অত্যন্ত ভালো। যোগ্য মানুষদের তিনি রেখেছেন এবং তা ভালো ফলাফল আনবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো। যত দ্রুত এটি করা যাবে, তত দ্রুতই সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারণ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকারের পক্ষেই বেশিকিছু টেকসই করা সম্ভব হয় না। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব এ সংস্কার কাজগুলো শেষ করবেন। কিন্তু এখানে জনগণের অংশগ্রহণের দরকার আছে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংস্কারগুলো করতে হবে।

তবে জনগণের মতামতকে তারা কীভাবে সম্পৃক্ত করবেন, সে প্রক্রিয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ঠিক করবেন।গত ১৫ বছর এদেশের মানুষ কথা বলতে পারেনি। অভাব অভিযোগের কথা বলতে পারেনি। বিচার পায়নি। সে জায়গায় স্বাভাবিকভাবে যখন এমন একটি মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সব মানুষই তাদের কথাগুলো বলতে চায়; তাদের অভিযোগগুলো আনতে চায়। এটি অস্বাভাবিক না। তবে আমি মনে করি যৌক্তিক আচরণ হচ্ছে যে এখন কিছুদিন এ সরকারকে সময় দেয়া। সরকার কাজ করছে। কাজ করতে দিতে হবে। পরামর্শগুলো দিতে হবে এবং এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে এ সরকার একটি বিরূপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে। ড. ইউনূসের সরকার বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে চেষ্টা করছে। একেবারে মুহূর্তের মধ্যে সব হয়ে যাবে না, সেটি বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।যেহেতু একটা ফ্যাসিবাদী সরকার ছিল,একেবারে পুরো দলবাজ একটি সরকার ছিল। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় বেশির ভাগই ছিল দলীয় লোক। রাতারাতি তো এ লোকগুলোকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। তাদের তো কাজ করতে দিতে হবে। তবে অভিজ্ঞতা বেশি থাকলে হয়তো আরো ভালো করতে পারত। অথবা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও হয়তো আরো ভালো করত। এ যোগাযোগের জায়গাটায় কিছুটা অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে। এখানে যারা পুরনো লোক আছেন, অভিজ্ঞ লোক আছেন তাদের সঙ্গে ঘন ঘন কথা বললে বা যারা সরকার চালিয়ে অভিজ্ঞ, তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। মুহূর্তের মধ্যে তো সবকিছু ঠিক হবে না। আমাদের ব্যবসায়ীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক পরিবেশ, বিভিন্ন ক্ষেত্র মাথায় রাখতে হবে। রাতারাতি তো পরিবর্তন হয় না। সুশাসন লাগে। একটু সময় লাগবে। চর্চা করতে হবে।

অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর এখন যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে দেশকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ভালো জায়গায় নিয়ে আসবে। মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পশ্চিমা রাষ্ট্রের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক রয়েছে ঠিকই। কিন্ত কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা শক্তির প্রভাবের কথা এখানে আসছে না। এখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষ যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়, সেটির প্রভাবই এখানে বেশি পড়েছে। এখানে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। এটিকে তারা সমর্থন করেছে যেহেতু এটা জনগণের অভ্যুত্থান ছিল। সুতরাং শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয়,সমস্ত বিশ্বই এটিকে সমর্থন করবে।বাংলাদেশে আগে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে এবারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন অন্যতম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ঘটেনি, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বটে, কিন্তু ‘অভ্যুত্থানটি ঘটেছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। আন্দোলন দমনে এমন নৃশংসতা আগে কখনো দেখা যায়নি। মানুষের প্রতিরোধও ছিল অসামান্যরূপে ঐক্যবদ্ধ ও দুঃসাহসী। এবং অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিরোধিতা ছিল অভ্যুত্থানের মূল চালিকা শক্তি। বর্তমানে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আশার বাণী কিছুটা হলেও সঞ্চার হয়েছে। সবার কথা আগে দেশ সংস্কার, এরপর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন হোক।অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

যে কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে তার কর্মকাঠামো আগামী ১ অক্টোবর চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করা হবে এবং তিন মাসের মধ্যে কমিশনের সুপারিশসহ প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শ্রমের সমমজুরির অধিকারে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শুধু কমিশন করলেই এসব সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরি। উপযুক্ত ব্যক্তিকে যথার্থ দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। এ দেশের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ লোকের জীবন-জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। শ্রমজীবী মানুষও প্রায় ২ কোটি। এদের কথা মাথায় নিয়ে সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তিন বেলা ভাতের অধিকার নিশ্চিতে তাদের জন্য সংস্কারকাজ করতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নয়নের রোডম্যাপ হবে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। সব শ্রেণির মানুষের অধিকারের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারে তৃণমূলের মানুষের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করবে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা থাকতে হবে জনসাধারণের। দেশের প্রতিটি স্তরে যে বৈষম্য তা দূর করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করলেও পরবর্তী সরকার যাতে এ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য একটি টেকসই সমাধান প্রয়োজন। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ও আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তাকে মর্যাদা দেওয়া ও স্থায়ী করা। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, যেমন অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দান; যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ও মানুষকে আহত করেছে, সেই অপরাধীদের আইনি ব্যবস্থার অধীন আনা।

তা ছাড়া পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে যে অপরিমেয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তার লাগাম টেনে ধরা; সম্পদ পাচার, লুণ্ঠন ও দুর্নীতি বন্ধ করা; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা; দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চতকরণ, সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া; পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা পরিহার করে উন্নয়নকে সামাজিক মালিকানার অভিমুখী করার নীতি গ্রহণ। মোটকথা হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। মনে হয় অবস্থা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ভীতি বা শঙ্কার ক্ষেত্রে বলব, যারা ভালো কাজ করেছেন, তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা দলীয় ক্যাডারের মতো কাজ করেছে, তাদের জন্য কিছুটা এরকম থাকবে। যারা দলদাসের মতো আচরণ করেছে, তারা খেসারত দেবে। কিছুক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি দ্রুতই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর এতে করেই সংস্কারে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে এটাই সবার বিশ্বাস।


লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।


আমার বার্তা/জেএইচ