বাংলাদেশে লোক কাহিনীর চলচ্চিত্র
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:০৯ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লোক চাহিদার প্রভাব যথেষ্ঠ তাৎপর্যময়। উর্দু চলচ্চিত্রের আধিক্যের স্থলে লোক কাহিনীর চিত্রায়ন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, ‘রূপবান’ যাত্রার আগমন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে চারভাবে প্রভাবিত করেছে।
(১) লোক ঐতিহ্যের দিকে অর্থাৎ শেকড়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পেরেছে ?
(২) যাত্রার জনপ্রিয় কাহিনীকে চিত্রায়নের মাধ্যমে সাধারণ দর্শককে বহুমুখী করতে সহায়তা করেছে।
(৩) বাংলা চলচ্চিত্রের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে।
(৪) উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে বাঙালি পরিচালককে নিরুৎসাহিত করেছে।
১৯৬৭ সালে ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’-এর পরিচালক সফদার আলী ভূঁইয়া ‘ঝুমুর যাত্রা’র জনপ্রিয় পালা ‘কাঞ্চনমালা’র কাহিনী চলচ্চিত্রে রূপ দেন। ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান’-কে চলচ্চিত্রায়িত করেন পরিচালক আজিজুর রহমান (১৯৩৯)। ১৯৬৮ সালে আজিজুর রহমান নির্মাণ করেন ঝুমুরযাত্রার নন্দিত পালা ‘মধুমালা’ এবং ইবনে মিজান নির্মাণ করেন ‘রাখালবন্ধু’। রূপবানের কাহিনী নিয়ে নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক ই.আর. খান ‘রূপবানের রূপকথা’ নামে। ১৯৬৯ সালে ময়মানসিংহ কাহিনিভিত্তিক ‘বেদের মেয়ে’ ও ‘মলুয়া’ চিত্রায়িত হয়। ‘রূপবান’-খ্যাত পরিচালক সালাহউদ্দিন চলচ্চিত্রে রূপ দেন ‘আলোমতি প্রেমকুমার’ যাত্রাপালার কাহিনীকে।
পরিচালক ইবনে মিজান ‘আমীর সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’ নির্মাণ করেন ১৯৭০ সালে। ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নিমাই সন্ন্যাসী’ ও ‘লালন ফকির’ চলচ্চিত্রের কাহিনী যাত্রা-অপোরার মাধ্যমে সারাদেশে আগেই জনপ্রিয় ছিল। এদুটি চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন সিরাজুল (জ. ১৯৩৮) সৈয়দ হাসান ইমাম (জ. ১৯৩৫)। ১৯৭৬ সালে লোককাহিনি ‘কাজলরেখা’ চিত্রায়িত করেন সফদার আলী ভূঁইয়া। এ বছর চলচ্চিত্র শিল্পে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম হয়। মোহাম্মদ আলী মিন্টুর পরিচালনায় ‘বর্গী এলো দেশে’ যাত্রাপালার হুবহু চলচ্চিত্রের রূপ দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ‘সাগর-ভাসা’ নামের একট্ িলোককাহিনী চিত্ররূপ। ১৯৮৪ সালে সফদার আলী ভূঁইয়া নির্মাণ করেন ‘রসের বাইদানী’ (১৯৮৪)। এটি জনপ্রিয় ‘বেদের মেয়ে’র প্রভাবজাত। ১৯৮৫ সালের ৬৫টি চলচ্চিত্রের মধ্যে আজিজুর রহমানের ‘রঙিন রূপবান’, মতিন রহমানের (জ. ১৯৫২) ‘রাধাকৃষ্ণ’, মহম্মদ হান্নানের (জ.১৯৪৯) ‘রাই বিনোদিনী’ এবং হারুনুর রশীদের (জ.১৯৪০) ‘গুনাইবিবি’ ছিল লোককাহিনী থেকে নেয়া। ১৯৮৬ সালে ৪টি, ১৯৮৭ সালে ৩টি, ১৯৮৮ সালে ২টি, ১৯৮৯ সালে ৬টি, ১৯৯০ সালে ১টি, ১৯৯১ সালে ৩টি এবং ১৯৯২ সালে ১টি চলচ্চিত্রের মধ্যে লোকজ জীবনের অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮৯ সাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত, মতিউর রহমান পানু (জ. ১৯৪০) প্রযোজিত এবং অঞ্জু ঘোষ (জ. ১৯৬৬) অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্রটি এই গুরুত্বের প্রধান কারণ।
লোকজ কাহিনীর চলচ্চিত্রায়ণ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ব্যাপার। প্রতিটি দেশের সাস্কৃতিক মূলধারার সঙ্গে লোকসংস্কৃতির গভীর সংযোগ রয়েছে। আশার কথা এই যে, চলচ্চিত্র শুরুর পর্বে লোকনাট্য এবং যাত্রার কাছ থেকে অর্র্থাৎ নিজস্ব সংস্কৃতি থেকেই উপাদান গ্রহণ করে সফলতা অর্জন করে। কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্র শিল্পে হিন্দি চলচ্চিত্রের ফর্মুলা নকল করোর প্রতিযোগিতা বড় দৃষ্টিকটু হয়ে পড়েছে। দর্শকরা বেশি চলচ্চিত্র দেখতে এখন আর সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ দেখায় না। যে যাত্রা বা লোককাহিনী আমাদের দেশ থেকে আসল উর্দু চলচ্চিত্র হটিয়ে দিয়েছে, সেই যাত্রা বা লোককাহিনি নকল হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রভাব তাড়িয়ে সুস্থ ও স্বকীয় ধারা পুনর্নিমাণ করতে পারে।
গবেষণার সুবিধার জন্য ৭টি চলচ্চিত্রকে বেছে নেয়া হয়েছে। যেগুলো লোককাহিনির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত । এগুলো হলো সালাহুউদ্দিনের রূপবান, জহির রায়হানের বেহুলা, ইবনে মিজানের রাখালবন্ধু, দিলীপ সোমের সাতভাই চম্পা, সফদর আলী ভূইয়ার কাজলরেখা, হারুনুর রশীদের গুনাইবিবি এবং তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা।
রূপবান গ্রামবাংলা প্রচলিত ও জনপ্রিয় লোককাহিনির থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র। রূপবান কাহিনিীতে লোকাচার ও লোকঅনুষ্ঠান হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান, বাসররাত, লোকবিশ্বাস প্রভৃতি। লোকসুরের আধিক্য এবং দ্বন্দ্বমুখর কাহিনির কারণে রূপবান বাঙালির লোকজীবনের চিরায়ত রূপরেখা হয়ে উঠেছে। বেহুলা চলচ্চিত্র চিরায়ত পৌরাণিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। পৌরাণিক কাহিনির চিত্রায়ণকে আমরা লোকজন জীবনের চিত্রায়ন বলে বিবেচনা করতে পারি। বেহুলার কাহিনী সনাতন জীবনধারায় নিবিড়ভাবে মিশে আছে। রাখালবন্ধু কাহিনিতে লোকসঙ্গীতের প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাহিনীকে লোকজীবঘনিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। রাখালবন্ধু চলচ্চিত্র ফোকফ্যান্টাসিতে পূর্ণ। গ্রামের পরিবেশ, নদীতীর গরুচরানোর মাঠ, নৌকাবিলাস, পালকিযাত্রা সবকিছু মিলিয়ে লোকজন আবহ সৃষ্টির চেষ্টা রয়েছে। সাতভাই চম্পা চলচ্চিত্রে লোকজীবনের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। রানীদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে ছয় ছেলে ও এক মেয়ে ফিরে পাওয়ার কাহিনীর মধ্য দিয়ে সত্যের জয় ঘোষিত হয়েছে। রূপকথার কাহিনি কাজলরেখায় লোকশিক্ষার কিছু উপাদান থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা যায়। গুনাইবিবির পালা জনপ্রিয় কাহিনির পুর্নবিন্যস্ত চিত্ররূপ। চিত্রায়ণের প্রয়োজনে মুলকাহিনির কিছু বিচ্যুতি ঘটলেও তাতে প্রকৃত রস ও সুর নষ্ট হয়নি। এতে রূপায়িত প্রতিটি দৃশ্যই লোকজীবন থেকে নেয়। লোকগাথার রূপায়ণের কারনে গুনাইবিবি জনমনে আকর্ষণ করেছে। বেদের মেয়ে জোসনার জনপ্রিয়তার পেছনেও হয়তো বাঙালি দর্শকের ঐতিহ্যপ্রীতি ক্রিয়াশীল। সর্পবিশ্বাসও এই অঞ্চলের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। লোকজ গানের সুর ও শারীরিক কসরত ও সর্বোপরি লোকজীবনের চিত্রায়ণী এই চলচ্চিত্র দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হয়ে উঠেছে।
আমাদের লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে লোকসংগীত। বাঙালির প্রাণের এই সম্পদ লালন ও প্রচার করার ক্ষেত্রে আলোচিত চলচ্চিত্র গুলোর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যমগিুত লোকজীবনের সন্ধান করতে লোক কাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রের কাছে বার বার ফিরে যেতে হয়।
অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য কারণে সুবিধাজনক অবস্থান থাকায় সেখানে চলচ্চিত্র নির্মানের স্টুডিও এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গড়ে ওঠে। আর তখনকার পূর্ব বাংলা হয়ে ওঠে কলকতা, বোম্বাই, লাহোর ও ইউরোপ-আমেরিকার চলচ্চিত্রের বাজার। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৩০ এর দশকে ঢাকার নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে এ্যাডভেঞ্জার হিসেবে নির্মিত হয় নির্বাক স্বল্প দৈর্ঘ্য চিত্র ‘সুকুমারী’ (১৯২৭-২৮) ও পূর্ণ দৈর্ঘ্য কাহিনী চিত্র ‘দি লাস্ট কিস বা শেষ চুম্বন’ (১৯৩১)। ঐ দু’টি ছবির প্রিন্ট পরবর্তীতে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রদেশ হিসেবে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর রাজধানী ঢাকায় সরকারীভাবে ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বা এফডিসি’ স্থাপিত হয় ও চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। এর আগে ল্যাবরেটরীহীন নির্মিত হয় তথ্যচিত্র নাজীর আহমেদের ‘ইন আওয়ার মিডস্ট, (১৯৪৮), প্রমাণ্যচিত্র ‘সালামত’ (১৯৫৪), এবং আবদুল জব্বার খানের সাবক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)।
১৯৫৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কয়েকটি ধারা লক্ষনীয় যেমনঃ
১। সামাজিক চলচ্চিত্র।
২। উর্দুভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র (১৯৫৯-১৯৭০)।
৩। লোকগাঁথা ও রূপকথা ভিত্তিক চলচ্চিত্র।
৪। ইতিহাস ও গণআন্দোলন ভিত্তিক চলচ্চিত্র।
৫। মারদাঙ্গা চলচ্চিত্র।
৬। মুুিক্তযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র।
৭। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
৮। প্রমাণ্যচিত্র।
৯। অন্যান্য চলচ্চিত্র (অশ্লীল, প্রতিহিংসাপরায়ন, কুরুচিপূর্ণ)।
কলকাতায় নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র যেমন ‘পথের দাবী’ (১৯৪৬), ‘জয়তু নেতাজী’ (১৯৪৭), ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৯৫৯), ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ (১৯৪৯), ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৫২) ‘বাশের কেল্লা’ (১৯৫৩), প্রভূতিতে যুদ্ধ, বিপ্লবী চেতনা ও প্রতিরোধের ছাপ রয়েছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কোন না কোনভাবে (সিনেমা হল বা টিভি পর্দায়) বাংলা চলচ্চিত্র দেখে থাকে। আমি ও ছোটবেলা থেকেই বাংলা চলচ্চিত্র দেখে আসছি। এক সময় বাংলা চলচ্চিত্র পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপভোগ করা যেতো। মাঝখানে অবশ্য বালা চলচ্চিত্রে পাশ্চাত্যের মত অশ্লিলতা দেখা দেয়। বর্তমানে চলচ্চিত্রে অবশ্য অশ্লিলতা বহুলাংশেই কমে গেছে। চলচ্চিত্রে বর্তমানে অত্যাধুনিকতা থাকলেও সুস্থ্য বিনোদন রয়েছে। বাংলা শিক্ষনীয় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপক সুযোগ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলদেশ সরকারের অনুদানে এদেশে শিক্ষনীয় আরো বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ করা উচিত।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পঞ্চাশ বছর লোকজীবনের উপস্থাপনা (ড.তপন বাগচী), আমাদের চলচ্চিত্র (মো: ফখরুল আলম), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র (অনুপম হায়াৎ)।
লেখক : কমল চৌধুরী-সিনিয়র সাংবাদিক, ও কবি, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই