মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:২৭ | অনলাইন সংস্করণ

  ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম:

শুরু হলো বিজয়ের মাস ডিসেস্বর। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই মাসের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে রচিত হয় সবচেয়ে বড় গৌরবের অধ্যায়। গৌরবের এই বিজয়ের ৫৪ বছর ইতোমধ্যে পার হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়। বাঙালি জাতি হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসে। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ শাসন, শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তির পর পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনই এক পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।

স্বাধীনতার জন্য ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭১ এর মার্চে এসে স্ফুলিঙ্গে রূপ নেয়। স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তানি জান্তারা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্বরোচিতভাবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পরই ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতায় বাঙালি নিধন অভিযান।

তবে পাকিস্তানের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। হাতে তুলে নেয় অস্ত্র, শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চলে বাঙালির মরণপণ যুদ্ধ। বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বাঙালি বিজয়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চুড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। এক পর্যায়ে বাঙালির বীরত্বের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত জোরালো হয়ে ওঠে।

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ মরণপণ যুদ্ধের কাছে টিকতে না পেরে এবং বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। রক্তক্ষয়ী এই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণায় তিনি তুলে ধরেছেন সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাস্তবতা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমাম নিয়মিত গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। শীতের শুরুতে তিনি শীতবস্ত্রও কিনে পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বাধিকারের আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায় ডিসেম্বর মাসে। বিশ্বের বুকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় বাংলাদেশ নামের এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নতুন ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে বাঙালি। শোষণ-বঞ্চনা চলে ২৩ বছর। ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু করে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর সত্তরের নির্বাচনের পথ ধরে চলে আসে ঐতিহাসিক একাত্তর। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তাদের পরিকল্পিত গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু প্রাণ ও নারীর সভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি দেখা পায় তার পরম আকাক্ষিত স্বাধীনতার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লেখক, শিক্ষক, শিল্পীসহ জাতির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের অনেককে। ডিসেম্বর তাই বাঙালি জাতির জন্য যুগপৎ উৎসবের মাস।

এবার বিজয়ের মাস উদযাপিত হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। আবারও বহু প্রাণের বিনিময়ে প্রায় ১৬ বছরের একটানা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়। এবার তাই কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিজয়ের মাস ও বিজয় দিবস।  বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর পালিত হবে বিজয় দিবস।  বিজয় দিবস সামনে রেখে এবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিটি জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এবং চারু, কারু ও স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত শিল্পপণ্য নিয়ে বিজয়মেলা আয়োজন করবে বলে জানা গেছে।  

মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা : বেশ কয়েক বছর ধরে ১ ডিসেম্বর কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করে আসছে। তবে এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দিবসটি পালন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।   ১ ডিসেম্বরের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে “সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১” ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর এদিন সকালে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন বেদিতে সমবেত হয়ে দিবসটি উদযাপন করেন। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবার দিবসটি উদযাপন করছে।


লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন।

 

আমার বার্তা/ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম/এমই