নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারতকে উগ্রতা পরিহার করতে হবে

প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার:

ভারত আর বাংলাদেশ দুই অকৃত্রিম বন্ধুদেশ; তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক মিত্রতা আছে-এ কথা আমাদের সবারই জানা কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশটির দায়িত্বশীল নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে,এই দুই দেশের মধ্যে কি আসলেই মিত্রতা ছিল? যদি থাকে, তাহলে সেই মিত্রতা কি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের মিত্রতা ছিল, নাকি হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি শাসিত ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শাসক দল আওয়ামী লীগের মিত্রতা ছিল?যদি দুই দেশের মিত্রতা থেকেই থাকে,সেটি কি বড় লাট লর্ড ওয়েলেসলির আমদানি করা অধীনতামূলক মিত্রতা? অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তা কি আদৌ ভারত-বাংলা দেশের মধ্যে ছিল বা আছে? দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত জনধারণা হলো, শেখ হাসিনার পতনকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি, খারাপভাবে নিয়েছে। কিন্তু সেই খারাপভাবে নেওয়ার মাত্রা যে কতখানি গভীর, তা প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে দিল্লি আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনা দিল্লির মিত্র। এরপর তারা বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এরপর আমদানি- রপ্তানি সীমিত করেছে। এরপর সংখ্যালঘু ইস্যুতে একের পর এক তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারতের বিজেপি সরকার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের সমর্থকেরা সব ধরনের রাখঢাকের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই মুহূর্তে ভারতের সম্পর্ক ঠিক স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ভারতের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তারা কোনোভাবেই মানতে পারছে না।

আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হামলা করেছে।ভাঙচুর করেছে ও আমাদের জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছে। এ ঘটনায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেছিল বাংলাদেশ সরকার। স্বভাবতই ভারতীয় উগ্রপন্থীদের এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশিদের আহত করেছে। তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এর আগে কলকাতায় উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও হামলার চেষ্টা করেছিল একদল ভারতীয়। ওই ঘটনার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। যদিও আগরতলায় হামলার পর ভারত দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর ভারতের আচরণ কখনোই বন্ধুসুলভ মনে হয়নি।প্রতিবেশী হিসেবে ভারত একচেটিয়া শেখ হাসিনার দলকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এটা দেশের সাধারণ মানুষকে ক্রমেই ভারতবিরোধী করে তুলছে। ভারতকে বুঝতে হবে যে জুলাই বিপ্লব কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল গণমানুষের আন্দোলন। আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামপন্থী, বামপন্থীদেরও অংশগ্রহণ থাকলেও এটি একটি গণচরিত্র ধারণ করেছিল ও এই গণ-আন্দোলনের মুখেই স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে নিরন্তর হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। একবার চট করে দেশে ঢোকার কথা বলেছেন, আবার তালিকা করে ধরে ধরে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কের সভায় ভিডিও ভাষণে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পরিকল্পনাতেই গণহত্যা হয়েছে। আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত এখন নির্বিঘ্নে শেখ হাসিনাকে এসব কথা বলতে দিয়ে এ দেশের মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলছে। ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমাগত অপতথ্যও ছড়ানো হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।


ভারতীয় রাজনীতিবিদেরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা সময় এমন সব কথা বলছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। চিন্ময়ের আটক হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন। পেঁয়াজ, আলু পাঠানো বন্ধ করে দেবেন বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানোর মতো উদ্ভট কথাও বলেছেন। ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের আচরণে মনে হচ্ছে, তাঁরা রাগে ফুঁসছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করাই কি তাদের রাগের কারণ? হতে পারে শেখ হাসিনা ভারতকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এখন তিনি পালিয়ে যাওয়ায় ভারতের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের সংযত আচরণ করা উচিত। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিবেশী কোনো দেশেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতের প্রতি ভালো ধারণা নেই। নিরাপত্তার কারণেই প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারতের হাতে রাখা দরকার। এটা করতে গিয়ে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছে। নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করেছে। এটা টেকসই কূটনীতি নয়। একসময় না একসময় ভারতপন্থী সরকারগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে।এর ফাঁকে জনসাধারণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে ভারত শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং ভারতের রাজনীতিবিদেরা একের পর এক উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। নিরাপত্তার খাতিরেই ভারতকে উগ্রতা পরিহার করতে হবে এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে হবে এই বলে যে তারা সৎ প্রতিবেশী হিসেবে অন্যদের ক্ষতির কারণ হবে না। ভারত যদি এ ধারণা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে তৈরি করতে পারে, তাহলে ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি এমনিতেই কমে যাবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে ভারত। সীমান্তে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে, উজানে নদীর পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে নিজের স্বার্থ আদায় করতে চেয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু ভারত যদি সীমান্তে হত্যা বন্ধ করে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে নদীর পানি বণ্টন করে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলেই ভারতবিরোধী মনোভাব এমনিতেই কমে আসবে এবং নিরাপত্তাঝুঁকিও কমবে। নিরাপত্তাসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশকে ভারতের প্রয়োজন। আবার ভারতকেও বাংলাদেশের প্রয়োজন। তাই আস্থার সম্পর্ক বজায় থাকলে উভয় দেশই লাভবান হবে। কিন্তু ভারত চাপ দিয়ে একচেটিয়াভাবে স্বার্থ আদায় করতে চাইলে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকি যেমন বাড়বে,ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকিও বাড়বে।মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই দেশের সাধারণ মানুষ। গত ১৫ বছরে মনে রাখার মতো যা যা ভারতকে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো নামমাত্র শুল্কের ট্রানজিট, যা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য বাংলাদেশের সড়ক এবং জলপথে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে যাচ্ছে। আরও দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি। তিস্তার পানি না পেলেও দেওয়া হয়েছে ফেনী নদীর পানি। শত শত কোটি টাকার ক্ষতি করে মোদির বন্ধু আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণের উৎস বানানো হয়েছে।বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের বহু ছাপাখানা থাকার পরও ভারতের ছাপাখানা গুলোকে আমাদের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আইটি খাতে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচারের সুযোগ না পেলেও ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচার নিশ্চিত করা হয়েছে।

বছরজুড়ে সীমান্তে অসংখ্য বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে মরলেও ধারাবাহিকভাবে চুপ থাকা হয়েছে।সর্বশেষ প্রহসনের নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর গত ২২ জানুয়ারি শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে বাংলাদেশে ঢুকে বিজিবি সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নিয়ে কয়েক দিন পর ফেরত দেওয়ার পরও সরকারের দিক থেকে চুপ থাকা হয়েছে। এ ধরনের দেওয়া’র তালিকা অনেক। অকাতরে এসব দেওয়া’র বিনিময়েই যে আওয়ামী লীগ তিনটি হাস্যকর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এত দিন টিকে ছিল, তা মোটামুটি সবাই জেনেছেন। ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে যে শেখ হাসিনা সরকারের একটি অলিখিত অধীনতামূলক মিত্রতা’র চুক্তি হয়েছিল, তা এখন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন থেকে বোঝা যাচ্ছে। ভারতের এখনকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং উন্মাদের মতো রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, অভ্যুত্থান ঘটানো ছাত্র-জনতা ভারতের সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে আচমকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির পথে হেঁটে শেখ হাসিনার মাধ্যমে ভারতই বাংলাদেশের যাবতীয় নীতি ঠিক করত, এখন সেটি শেষ হয়ে গেছে। এর আগে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানে প্রভাব হারিয়েছে ভারত। বাংলাদেশই ছিল ভারতের সর্বশেষ দাদাগিরিস্থল। গত ৫ আগস্ট সেটিও ছুটে গেছে।এটি ভারত মেনে নিতে পারছে না। আবার সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে ফেরতও আনতে পারছে না। ফলে তারা উন্মাদের মতো কূটনীতি বহির্ভূত এলোমেলো আচরণ করছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ভারতকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষীণতম সম্ভাবনাও নেই। এ কারণে ভারতকে আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো নির্দিষ্ট একটি দলের সঙ্গে নয়, বরং রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে।


লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।


আমার বার্তা/জেএইচ