উদার গণতান্ত্রিক দেশ ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৯ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার:

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিক-ভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে।পৃথিবীর দেশে দেশে নানা মাত্রার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অনেক দেশে শাসকেরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিচ্ছে।এমন বিভ্রান্তি ছড়ানোরও চেষ্টা চলছে যে গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞা বা মূলনীতি নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রের যুগ থেকে শুরু করে মানবজাতি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য ও সর্বাধিক ন্যায়সম্মত শাসনব্যবস্থার অন্বেষণে যে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, সেখানে গণতন্ত্রের স্থান ও গুরুত্ব কোথায়? বিশ্বজুড়ে এমন প্রশ্ন জনগণের মনে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের মুখোশধারীদের আক্রমণ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। একদিকে তাঁরা নিজেদের দাবি করেন গণতন্ত্রী বলে, অন্যদিকে তাঁরাই আবার গণতন্ত্রের মূলনীতি এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। গণতন্ত্র, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা এবং সরকার বিষয়ে প্রায় চার শ বছরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায় দেখা গেছে যে গণতন্ত্রের চারটি মূল আদর্শ হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।কিন্তু গণতন্ত্র কেবল কতগুলো আদর্শিক নীতিই নয়,বরং এটি শাসনের একটি পদ্ধতিও।

এইতো কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাশিয়া ও চীনের মতো স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শাসন গুলোকে ধনিকতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।সেখানে প্রভাবশালী অলিগার্ক বা ধনকুবেররা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করতেন।রাশিয়ার পুতিন সরকারে ইউরি কোভালচুক, গেন্নাদি তিমশেঙ্কো ও রোতেনবার্গ ভাইদের স্পষ্ট প্রভাব ছিল। অন্যদিকে চীনে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ঝং শানশান ও মা হুয়াতেংয়ের মতো শতকোটিপতিদের বেড়ে ওঠায় সহায়তা করেছে। কিন্তু আজ উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও ক্রমে এই ধনিকতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন প্রশাসন এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। ট্রাম্পের ‘বিলিয়নিয়ার বয়েজ ক্লাব’-এ ইলন মাস্ক, হাওয়ার্ড লুটনিক, বিবেক রামস্বামীসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। ইলন মাস্ককে নতুন একটি সরকারি দক্ষতা বিভাগ-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিভাগটি প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের ‘সরকারি অপচয়’ কমানো এবং অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাতিল করার লক্ষ্যে কাজ করবে। নরেন্দ্র মোদির সরকারের এই সময়ে ভারতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মোদি প্রশাসন মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি ও সাজ্জন জিন্দালের মতো কিছু ধনকুবেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর লক্ষ্য হলো ব্যবসাবান্ধব নীতি চালু করা এবং অর্থনীতিকে আরও উদারীকরণ করা। শুধু ভারত নয়, এমন ধনকুবেরদের প্রভাব ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, তুরস্কসহ অন্য অনেক উদার গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ধনিকতন্ত্রের প্রতি এই বৈশ্বিক পরিবর্তন কীভাবে বোঝা যাবে? এখন ধনকুবেররা শুধু অর্থনীতির নয়, রাজনীতিতেও এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন,যা আগে কখনো দেখা যায়নি।এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি অর্থনীতির একটি বড় পরিবর্তনের অংশ।

আগে নব্য উদারবাদ, অর্থাৎ মুক্তবাজার-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হতো। এখন আমরা নব্যসামন্ততন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। নব্যসামন্ততন্ত্র হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে চরম বৈষম্যের কারণে বিশালসংখ্যক সাধারণ মানুষ কেবল ধনীদেরই সেবা করে বেঁচে থাকে। একাডেমিক ব্যক্তিত্ব জোডি ডিন এটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘কয়েকজন বিলিয়নিয়ার সমান এক বিলিয়ন অনিশ্চিত শ্রমজীবী।আজকের দিনেও বুলেট গতিতে বৈশ্বিক অসাম্যের দ্রুত বৃদ্ধি নব্যসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ১৯৮০-এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে আয়বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে চলেছে। এ প্রবণতা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা প্রায় সব বড় শিল্পোন্নত দেশ ও উদীয়মান বাজারে দেখা গেছে।নব্যসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো বর্তমান প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি। এখানে অ্যাপল, গুগল, মেটা, উবার এবং এয়ারবিএনবির মতো অল্প কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানি অসাধারণ ধনী হয়ে উঠেছে। এসব কোম্পানি তাদের মালিক ও শেয়ারহোল্ডারদের বিলিয়নিয়ারে পরিণত করেছে। তারা কম খরচে শ্রম, অস্থায়ী কর্মী ও সস্তা কারখানার ওপর নির্ভর করেছে। পাশাপাশি তারা সরকারের কাছ থেকে করছাড় ও বিনিয়োগের সুবিধা পেয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে আর কোম্পানিগুলো আরও ধনী হয়েছে। আজকের দিনে ধনী ব্যবসায়ীদের সরকারে জড়িত হওয়ার মূল কারণ হলো নিজেদের জন্য সুবিধাজনক কর ও বিনিয়োগনীতি নিশ্চিত করা এবং বিশাল মুনাফা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। ট্রাম্প, মাস্ক, আদানি বা বেরলুসকোনির মতো ব্যক্তিরা নিজেদের জনগণের নেতা হিসেবে দেখালেও তাঁদের নীতিগুলো মূলত করপোরেট লাভ বাড়ানো ও বাজারের দখল নেওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।


কিন্ত নব্যসামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি নব্য উদারবাদ থেকে আলাদা। এখানে মুনাফা অর্জনের জন্য আরও বেশি চাপ দেওয়ার ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজন হয়। যেহেতু নব্যসামন্ত তান্ত্রিকতাই আজকের বাস্তবতা এবং ধনকুবেরদের শাসন উত্তরোত্তর বাড়ছে, সেহেতু আমরা বুঝতে পারি, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলো ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে এগোচ্ছে। গত কয়েক দশকে যেটা সহজেই লক্ষ করা গেছে, তা হলো, দেশে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতন্ত্রায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের ওপর এতটাই জোর দেওয়া হয়েছে যে অনেক অগণতান্ত্রিক দেশ ১৯৯০-এর দশক থেকে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেখাতে চায় যে তারা গণতন্ত্রের চর্চা করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন নির্বাচনকে গণতন্ত্র সংহত হওয়া না হওয়ার পরীক্ষা হিসেবেই দেখিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, একটি দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে কি না, সেটা বোঝা যাবে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে ওই দেশ পরপর দুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারছে কি না, যাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। তাঁর ভাষায়, এটি হচ্ছে 'দুবার হাতবদলের পরীক্ষা'। পরাজিতরা ফলাফল মেনে নিয়েছে কি না এবং বিজয়ীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে পাল্টে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা করেছে কি না, সেটা গণতন্ত্রায়ণের নির্ধারক পরীক্ষা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারেরা ভোটারদের পাত্তা দেন না। সমালোচকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন ও জনসাধারণের অনুভূতিকে অবজ্ঞা করেন। এসব সত্ত্বেও তাঁরা তোষামোদ প্রত্যাশা করেন এবং তাঁদের সফলতার জন্য প্রশংসা শুনতে চান।তাঁরা শুনতে চান তাঁদের এ পর্যন্ত পৌঁছানো আসলে তাঁদের সক্ষমতা ও বিরোধীদের ব্যর্থতারই প্রমাণ।

গবেষণার ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য প্রধান যে কয়টি উপাদানকে অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে:সর্বজনীন ভোটাধিকার;আইনসভা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদের জন্য নিয়মিত অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও বহুদলীয় নির্বাচন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, যার মধ্যে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত। একই সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যার অধীনে সব নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা সত্যিকারের আইনি সম-অধিকার ভোগ করবেন। কোনো দেশকে গণতান্ত্রিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তাদের এসব মানদণ্ডেই উতরাতে হবে। কারণ, এর যেকোনো একটি অনুপস্থিত হলেই অন্যগুলোর উপস্থিতি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এগুলো মানা হয়নি বলেই তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সম্মুখে মারাত্মক সংকট দাঁড় করিয়েছে। কতিপয় আদর্শ গণতন্ত্রিক দেশও এই তালিকার বাহিরে নয়। উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই সকল দেশে গণতান্ত্রিক স্পেস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিকামী মানুষের জন্য এই প্রবণতা দুশ্চিন্তার কারণ বটে। জনগণের স্বার্থই এখানে প্রধান ও প্রথম। যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর কোন চর্চা নেই। সেখানকার ক্ষমতাসীনরা সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম বিতর্ক-সমালোচনা এবং কঠিন আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্তারক্তির পরও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। কিন্ত এটা জনগণের শাসন তথা গণতন্ত্রের পথে যে বড় অন্তরায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।


আমার বার্তা/জেএইচ