প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:০৫ | অনলাইন সংস্করণ
রহমান মৃধা:
দেশের চাকরিজীবীরা নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান—নির্ধারিত বাসাবাড়ি, গাড়ি ও অবসরের পর পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি। কিন্তু এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও অনেকেই দুর্নীতি, লুটপাট ও অনৈতিক কাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করছেন।
অন্যদিকে প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বছরের পর বছর প্রিয়জনদের থেকে দূরে থেকে বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশ চলে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হয়, কিন্তু তাঁরা নিজেরাই রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আর যাঁরা দশকের পর দশক দেশের বাইরে কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং অর্জিত সবকিছু দেশে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা একটি প্রশ্ন তোলেন—‘যদি আমরা দেশে ফিরে স্থায়ী হতে চাই, রাষ্ট্র আমাদের জন্য কী ব্যবস্থা করেছে? আমাদের ভবিষ্যৎ কি সুরক্ষিত?’
এই প্রশ্ন শুধু আমার নয়, এটি কোটি প্রবাসীর মনের আর্তি। কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে?
প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের পাঠানো অর্থ দেশের জিডিপির ৭-৮ শতাংশের বেশি।
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, দরিদ্র পরিবারের জীবন মান উন্নয়ন এবং ছোট ব্যবসার প্রসারে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা এই রেমিট্যান্স, যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
প্রবাসীরা তাদের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা, শোষণমূলক কাজ এবং অনিরাপদ পরিবেশে বছরের পর বছর কাটান।
অন্যদিকে দেশে যাঁরা দুর্নীতি আর লুটপাটে মগ্ন, তাঁরা আরামদায়ক জীবন যাপন করছেন। কিন্তু যাঁরা দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি তৈরি করছেন, তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে একপ্রকার উপেক্ষিত।
রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জীবন শুধুই পরিশ্রম ও ত্যাগের এক কষ্টের গল্প হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের জন্য অবিরাম কাজ করেও তাঁরা অবহেলিত থেকে যান। তাঁদের জন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই, অবসরকালীন কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমনকি বিপদের সময় কোনো সাহায্যও নেই।
রাষ্ট্রের উচিত এই অবহেলা দূর করে প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। কারণ, তাঁদের শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পেছনে রয়েছে তাঁদের রক্ত, ঘাম এবং অগণিত স্বপ্ন।
কোটি প্রবাসী মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই আর্তি অস্বীকার করে আর কত দিন দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা দেশের সম্পদ লুটপাট করবেন?
সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কোথায়, কীভাবে এবং কখন প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
তারা তো দেশের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করছেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো ন্যায্য ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্র তাঁদের অবদান স্বীকার না করে কেবল কথার ফুলঝুরি দিয়ে যাচ্ছে।
এখনো রাষ্ট্র শেখ হাসিনার নীতির পথেই হাঁটছে। গরিবদের অবহেলা করে আমলাদের অগাধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেন?
প্রবাসীদের জন্য পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে কেন এত দেরি হচ্ছে?
একটি দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের অবদানকে উপেক্ষা করা মানে নিজেদেরই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা।
প্রবাসীদের কথা না বলার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁদের রক্ত, ঘাম ও ত্যাগের মূল্যায়ন না করেই এই অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অমূল্য রত্ন। তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির মূল ভিত্তি। এ বৈদেশিক মুদ্রা শুধু দেশের জিডিপি বাড়াচ্ছে না; এটি গ্রামের অর্থনীতি, ছোট ব্যবসার প্রসার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তবে এই মহামূল্যবান অবদান রাখা মানুষগুলোর জন্য অবসরের পর কোনো আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকা রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখন সময় এসেছে তাঁদের প্রতি অবহেলার অবসান ঘটিয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত ব্যবস্থা গ্রহণের।
রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ—
১. পেনশন তহবিল গঠন: প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে একটি ছোট অংশ রেখে কেন্দ্রীয় পেনশন তহবিল তৈরি করা উচিত। এটি তাদের অবসরকালীন জীবনের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা দরকার, যা তাঁদের ভবিষ্যৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
২. বিনিয়োগে সহায়তা:
• প্রবাসীদের সঞ্চিত অর্থ সহজে বিনিয়োগের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
• দেশে বিনিয়োগকারীদের জন্য করছাড় এবং বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের অর্থনৈতিক ভূমিকা আরও জোরদার করা যেতে পারে।
৩. স্বাস্থ্য ও বিমা সেবা:
• প্রবাসীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবন বিমা প্যাকেজ চালু করা উচিত, যা দেশে এবং বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর থাকবে।
• তাঁদের পরিবারের জন্যও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা থাকা আবশ্যক।
৪. প্রতিনিধিত্বের সুযোগ:
প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় একটি শক্তিশালী জাতীয় সংস্থা গঠন করা দরকার, যাঁরা তাঁদের সমস্যা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপস্থাপন করতে পারবে।
৫. শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা:
• প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য দেশে বিশেষ শিক্ষার সুযোগ এবং বৃত্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
• তাঁদের পরিবারের জন্য সুরক্ষিত এবং সহজলভ্য সামাজিক সুবিধা চালু করা সময়ের দাবি।
প্রবাসীরা কোনো করুণার আবেদন করছেন না। তাঁদের শ্রম, ত্যাগ এবং মেধার বিনিময়ে যে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, তার যথাযোগ্য মর্যাদা ও সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তব্য। যদি রাষ্ট্র তাঁদের জন্য পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনিয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা শুধু প্রবাসীদের প্রতি নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকেও চরম অবিচার। প্রবাসীদের প্রতি উদাসীনতা শুধু তাঁদের জন্য নয়, দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি। সময়ের দাবি হলো ঐতিহাসিক এই বৈষম্য দূর করে প্রবাসীদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা। প্রবাসীদের প্রতি ন্যায্য অধিকার এবং সম্মান প্রদান কেবল রাষ্ট্রের কর্তব্য নয় বরং একটি সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য পদক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের এই সুযোগ হারালে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হবে ভয়াবহ। এখনই সময় প্রবাসীদের ত্যাগ এবং পরিশ্রমের যথাযোগ্য মূল্যায়ন করার।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
আমার বার্তা/জেএইচ