গুজব ও বাংলাদেশ : মরণব্যাধি ক্যান্সারের চেয়ে মারাত্মক
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২২ | অনলাইন সংস্করণ
সাদিয়া সুলতানা রিমি
‘গুজব’ বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত একটি শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ আকারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আর গুজব তৈরির কারখানা বলা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। এখন মানুষ সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে যা আসে সেটাই শেয়ার করে দেয়। কোনো রকম বিচারবিশ্লেষণ না করেই তারা সেটা শেয়ার করে দেয়। এর ফলে অনেক সময় অনেক বড় সমস্যা হয়ে যায়। যা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। একটি মিথ্যা বা অর্ধসত্য তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং ভয় তৈরি করে।
বর্তমানে একটি গুজব ছড়াতে খুব বেশি সময় নেয় না। মুহূর্তের মধ্যে সেটি পুরো দেশে বিস্তার করে ফেলে। মানুষের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে অনেক সময় অনেক স্বার্থান্বেষী মহল এটা করে থাকে। এরফলে যারা না জেনেশুনে এগুলো শেয়ার করে তারা পরবর্তী সময়ে বিপদে পড়ে যায়।গুজব ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ এটি মানুষের মনের মধ্যে বিষ বসায়, যা বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। ক্যান্সার, যদিও একটি মরণব্যাধি, তার চিকিৎসা রয়েছে এবং মানুষ যদি দ্রুত চিকিৎসা নেয়, তবে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু গুজবের কোনও চিকিৎসা নেই। এটি মানবিক সম্পর্ক, সমাজ, এবং জাতীয় একতা ধ্বংস করতে পারে।
সাধারণত গুজব বলতে আমরা বুঝি যেকোনো বিষয় ভালোভাবে না জেনে তা প্রচার করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। তবে এটিকে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে তুলনা করলেও বেশি ভুল হবে না। গুজব সাধারণত ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা সামাজিক সাইটগুলোর মাধ্যমে। অন্যদিকে ভার্চুয়াল জীবনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে কিছু অসাধু স্বার্থলোভী মানুষ সমাজে গুজব ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে বাস্তব জীবনে ছড়িয়ে পরলে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে যখন । তবে সেটিকে সামাজিক সাইটগুলোতে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন সেটি আর ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পরে। এতে জনমনে ভীতি সৃষ্টি হয়।
গুজব প্রাথমিকভাবে শুরু হয় ছোট একটি সত্য বা মিথ্যা থেকে, যা ধীরে ধীরে নানা উপায়ে বিকৃত হয়ে মানুষের মস্তিষ্কে এক অন্ধকার ছায়া তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো রাজনৈতিক বিষয়, ধর্মীয় বা সামাজিক আন্দোলন নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে, তা গোটা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এসব গুজবের কারণে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অপপ্রচার এবং বিরোধিতা সৃষ্টি হয়। গুজবের ক্ষতি শুধু সমাজ বা দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে। পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয় এবং তাদের সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় গুজবের কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ে, যার ফলে তারা উদ্বিগ্ন, অবসাদগ্রস্ত বা বিষণ্ন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে একটি গুজব ছড়িয়ে যে ঢোলকলমির পাতা ছুইলেই নাকি মানুষ মারা যায়। সেই সময়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অনেক সংবাদপত্রেও প্রকাশিত করতে লাগলো দেশের কোথায় কতজন মারা গেলো। এর মধ্যে একদিন টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্টানে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত কসমোলজিস্ট প্রফেসর স্যার জামান নজরুল ইসলাম নিজের হাতে ঢোলকলমির পাতা হাতে মেখে, পাতার পোকা নিজের হাতে ধরে দেখালেন আসলে এসবে মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। অপ- বিজ্ঞানের সামনে বিজ্ঞানের সরাসরি প্রয়োগের কারণে মানুষ জানতে পেরেছিল যে ওটা নিতান্তই গুজব মাত্র। এছাড়া আলোচিত কয়েকটি গুজব সেগুলো নেট দুনিয়ায় রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো সে সময়।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে গত জুলাইয়ের শুরুতে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। পরে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে সেতু কর্তৃপক্ষ। পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে গুজবের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি মহল সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে আরেকটি গুজব ছড়ায়, তা হলো সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে। আর এ জন্য শিশুদের ধরে নেয়া হচ্ছে এবং তাদের মাধা কাটা হচ্ছে। এই ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে পড়লে সারােদেশে শুরু হয় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি। গণপিটুনিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে অনেকে নিহত হয়েছেন। পরে এ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করে সরকার। এই গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নত করে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছেলেধরা গুজবের রেশ না কাটতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনদিন বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ম্যাসেঞ্জারেরর মাধ্যমে গুজব ছাড়িয়ে পড়ে। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, এই খবরটি সঠিক নয়।
২০১৮ সালে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজের’ গুজব। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল’ থেকে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়। ফ্রান্সের থ্যালাস এলেনিয়া স্পেস কোম্পানি স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই স্যাটেলাইটের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রতিদিন সফলভাবে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি খবর বেনামি কিছু ওয়েবপোর্টাল ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি গুজব। এমন অসংখ্য গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে দেশ, সমাজ, ও জনমানব জীবনে যা প্রভাব পরে তা ক্যান্সারের চেয়ে ভয়াবহ।
গুজবের মারাত্মক প্রভাব প্রতিরোধের জন্য, আমাদের অবশ্যই তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতে হবে। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত তথ্যগুলি সবসময় যাচাই না করে বিশ্বাস করা উচিত নয়। গুজবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে, আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ গড়তে হবে।রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের যথাযথ ভূমিকার মাধ্যমে সত্যকে তুলে ধরা, সর্বোপরি ব্যক্তি সচেতনাই পারে গুজবের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার ।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার বার্তা/জেএইচ