ঢাকায় বায়ু দূষণের কারণ ও করণীয়

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

  সাদিয়া সুলতানা রিমি

ঢাকা শহর বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরীগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত উচ্চ হয়, যা নগরবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়েছে এবং দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে। বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বায়ুর মান এতটাই খারাপ থাকে যে, এই পাঁচ মাসে সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। গত আট বছরের চেয়ে গড়ে গত এক বছরে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়। বিশ্বের প্রভাবশালী স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণের কারণে ঘটা মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী ঢাকা তো অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি।

এ বছরের নভেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি তিন দিনের মধ্যে যে কোনো এক দিন ঢাকা শহরের বায়ুর মানসূচক ৩৩০-এর ওপরে থাকছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে ঢাকা একাধিক বার ৩০০-এর বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিত শহরের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ থেকে ঢাকার বায়ুদূষণের অবস্থান সহজেই অনুমেয়।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃত্যুর শতকরা ৮৯ ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। পরিবেশগত কারণে ও গৃহস্থালিসংক্রান্ত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের প্রভাবে প্রতি বছর ৬৭ মিলিয়ন মানুষের অকালমৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। এক গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশুদ্ধ বাতাস সুস্থতার অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক। খাবার, পানি বা বাসস্থান ছাড়া আমরা কিছু সময় থাকতে পারলেও নিশ্বাস গ্রহণ ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারি না। তাই, বায়ুদূষণের প্রকৃতি এবং রোধের উপায় জানা খুবই প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও শিল্পঘন শহরগুলোতে মোট ১১টি সার্বক্ষণিক বায়ু মনিটরিং স্টেশনের (CAMS ) -এর মাধ্যমে বায়ুদূষণের উপাদানসমূহের (বস্তুকণা, ওজোন, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি) পরিমাণ নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।

বায়ুর মান সূচকের রিপোর্ট করার জন্য ০-৫০ (ভালো), ৫১-১০০ (মাঝারি ভালো), ১০১-১৫০ (সাবধানতা), ১৫১-২০০ ( অস্বাস্থ্যকর), ২০১- ৩০০ (খুব অস্বাস্থ্যকর) এবং ৩০১-৫০০০ ( তীব্র অস্বাস্থ্যকর) এই স্কেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত অছও-এর মাত্রা ২০০ অতিক্রম করলে স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বেতার/টিভিতে প্রচার করা হয়ে থাকে।বর্ধিত জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, যানবাহন ও কলকারখানার পাশাপাশিঅপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম বায়ুদূষণের উৎস হিসেবে কাজ করে। মূলত বায়ুতে মাত্রাধিক সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5 I PM10), কার্বন মনোক্সাইড (CO), কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO,), সালফার অক্সাইডসমূহ (SOX), নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ (NOX), ওজোন (O3) উপস্থিতি, বস্তুকণা; যেমন—নাইট্রেট, সালফেট, এমোনিয়া, কালো কার্বন, এন্ডোটক্সিন এবং সূক্ষ্ম ধাতব কণাগুলো; যেমন—লোহা, কপার, নিকেল, জিংক ইত্যাদি; ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (CFC), ব্যাটারি, পেট্রোল, ডিজেল, হেয়ার ডাই থেকে নির্গত সিসা বায়ুদূষণের কারণ।

ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণসমূহ

ঢাকার আশেপাশে প্রায় ১,২০০টি ইটভাটা এবং কয়েক হাজার ছোট-বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। এই ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগই সনাতন পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, যেখানে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ও কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রচুর পরিমাণে ছাই, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।নগরীতে চলমান বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে প্রায় ৩০% বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। নির্মাণ সামগ্রী যথাযথভাবে না ঢেকে রাখা এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সময় সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে ধুলাবালি বাতাসে মিশে যায়, যা বায়ুদূষণ বাড়ায়।এছাড়া ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বায়ুদূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ফিটনেসবিহীন ও পুরনো যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, যা বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়।নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপরিকল্পিত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা পোড়ানো হয়, যা বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ। এতে মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি

বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার: সিএনজি, ইলেকট্রিক বা হাইব্রিড ইঞ্জিনের ব্যবহার বাড়ানো।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ: ২০ বছরের বেশি পুরনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা।

যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার কমিয়ে যৌথ পরিবহন ব্যবস্থার প্রচলন।

নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা: নির্মাণস্থলে বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি সামগ্রী ঢেকে রাখা এবং ধুলা কমাতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা।

নির্মাণ বিধি মেনে চলা: নির্মাণকাজের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসরণ নিশ্চিত করা।

পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার: ইটভাটা ও শিল্প কারখানায় আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা।
নির্গমন নিয়ন্ত্রণ: শিল্প কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

সঠিক বর্জ্য নিষ্পত্তি: আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করে সঠিক পদ্ধতিতে বর্জ্য নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।

পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ: বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বর্জ্য কমানো।

জনসচেতনতা কার্যক্রম: বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো।

কমিউনিটি উদ্যোগ: স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষায় কমিউনিটি উদ্যোগ গ্রহণ ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা।

ঢাকার বায়ুদূষণ একটি জটিল সমস্যা, যা সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে পারি।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আমার বার্তা/জেএইচ