শিশু ও নারীর কল্যাণে সরকারের অবদান
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫, ১৪:৩২ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:

সরকারের নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণীতে উত্তরনের সকল যোগ্যতা অর্জন করেছে।আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।বর্তমান সরকার শিশু ও নারীদের কল্যানেও ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র এবং জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেন।স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে শুরু হয় নারী উন্নয়নের প্রাতিষ্ঠানিক অভিযাত্রা ।শিশুর সুরক্ষাকল্পে ১৯৭২ সালের সংবিধানে শিশুর সকল অধিকার নিশ্চিত করেন এবং ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রনয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন।
সরকার জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈসম্য দূরীকরণ সনদ, (CEDAW) বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন এবং শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (CRC) সহ সকল আর্ন্তজাতিক সনদ অনুসরনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে।জাতিসংঘ কর্তক ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার সংঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ,রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর সম্পৃক্তকরণকে শক্তিশালী অনুঘটক এবং বহুমাত্রিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নারীর সার্বিক উন্নয়নকে বিবেচনা করা হয়েছে।রাষ্ট্র ও সমাজের মূল স্্েরাতধারায় নারীকে সম্পৃক্তকরণসহ শিশুর উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ‘জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ ও সুরক্ষিত শিশু ’ভিশন এবং ‘নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণ ’মিশন সামনে রেখে নিরলস কাজ করে চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমসমূহের বিস্তার ঘটেছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।দুস্থ মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচি (ভিজিডি),দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচি,শহরাঞ্চলে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল ,স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতির মধ্যে অনুদান বিতরণ,নির্যাতিত দুস্থ মহিলা ও শিশু কল্যাণ তহবিল,বিত্তহীন ও দরিদ্র মহিলাদের খাদ্য নিরাপত্তা কার্যক্রম ,মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রকল্পসহ মোট দশটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ুচালু করেছে। ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, ফরিদপুর, ক´বাজার , বগুড়া এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা একস্থান থেকে প্রদানের উদ্দেশ্যে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ও সিসি) স্থাপন করা হয়েছে।দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্থে ৪৭টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং দেশব্যাপী ৮টি রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টর স্থাপন করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার হতে আগত রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং এবং সমন্বিত সেবা প্রদানের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় কুতুপালং এ ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং কুতুপালং ও বালুখালিতে ১১টি মেন্টাল হেল্থ সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৭৬,৬৬১জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং প্রদান করা হয়েছে।
শিশুদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও বিনোদনমুলক উন্নয়ন ও সুস্থ প্রতিভার বিকাশ সাধনের উদ্যেশ্যে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কেন্দ্রীয় অফিস ,৬৪টি জেলা অফিস ও ৬টি উপজেলা শাখা অফিস কাজ কওে যাচ্ছে।প্রতিবছর বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মাধ্যমে ৩৬ হাজার শিশুকে সঙ্গীত,নৃত্য, চিত্রাঙ্কন,আবৃত্তি, অভিনয় এবং দাবাসহ ১২টি সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।এদেশের হতদরিদ্র শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মাধ্যমে মেয়ে শিশুদের জন্য ঢাকার আজিমপুরে ১টি কেন্দ্র এবং ছেলে শিশুদের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনাও চট্রগ্রামে একটি করে মোট ৬টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।প্রতিটি কেন্দ্রে দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবার ও বাসস্থানসহ লেখাপড়া, চিকিৎসা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ৬টি কেন্দ্রে মোট ৭৫০ জন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ও পুনর্বাসন করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বিভিন্ন কার্যক্রমের আওতায় দরিদ্র শিশুদের কল্যানে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ৬৪টি জেলা এবং ৬টি উপজেলা শাখাসহ মোট ৭১টি কার্যালয়ে ১টি শিশু বিকাশ ও ১টি প্রাক প্রথমি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ৪ থেকে ৫+ বছর বয়সি শিশুদেরকে শিশু বিকাশ বিষয়ক কার্যক্রমসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রম হিসাবে জয়িতা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ’শীর্ষক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সমাজের সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর জন্য দেশব্যাপী ‘জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ’শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৫ জন নারীকে জয়িতা চিহ্নিত করে নির্বাচন ও পুরষ্কার প্রদান করা হয়েছে।
মহিলাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য মহিলাও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের আওতায় সকল উপজেলায় মহিলাদের আয়বর্ধনের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষনের উদ্যেশ্যে‘ Income Generating Activities (IGA)Training of Women at Upazila level’ শীর্ষক প্রকল্প ২৮৩ কোটি ২২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে।এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়নে ‘তথ্য আপাঃ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) ’বাস্তবায়িত হচ্ছে।প্রকল্পের আওতায় গ্রামীন সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের ইন্টরনেট ব্যবহারের মাধ্যমে মহিলাদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।৪৯০ টি তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন ,বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে।প্রতিটি তথ্য কেন্দ্রে নিয়োজিত তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও তথ্যসেবা সহকারীগণ সংশ্লিষ্ট উপজেলার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ল্যাপটপ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা , স্বাস্থ্য, আইন, ব্যবসা, জেন্ডর এবং কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সহায়তা করছেন।সরকারী বিভিন্ন সেবাসমূহের তত্থ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারীর আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে একটি‘ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল’ রয়েছে।নির্যাতিত মহিলাগণ এ সেলের মাধ্যমে বিনা খরছে আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে২০২৩সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উল্লিখিত সেলের মাধ্যমে ১২১৮ জন নির্যাতিত মহিলাকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
বেকার ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি , আয়–নির্ভরশীলতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নারী সমাজকে মানব সম্পদে পরিনত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প (৩য় পর্যায়) –এর আওতায় ফ্যাশন ডিজাইন, ক্যাটারিং , বিউটিফিকেশন, বি এন্ড মাশরুম, ইন্টেরিয়র ডিজাইন এন্ড ইভেন্ট মেনেজমেন্ট এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।দেশের মোট ২৬টি জেলার ৩০টি উপজেলায় ৬টি বিষয়ে ৮২,৫০০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।ইতোমধ্যে ৭৭,৯৫০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্বরনীয় করে রাখা এবং তাঁর মহৎকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তিতে যে সকল নারী , জাতি গঠনের অগ্রযাত্রায় অনন্য ভুমিকা রেখেছেন তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে বেগম রোকেয়া পদক প্রবর্তন করা হয়েছে। নারী জাগরনের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবিস্বরনীয় অবদান চিরঞ্জীব করে রাখা এবং এ অবদান থেকে অনুপ্রনিত হওয়ার উদ্যেশ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উদ্যেগে ১৯৯৫ সাল থেকে ‘বেগম রোকেয়া পদক’ নামে এই রাষ্ট্রীয় পদকটি প্রবর্তন করা হয়েছে।প্রবর্তনের পর থেকে মোট ৫৬ জন নারীকে নারী শিক্ষা, নারী অধিকার , নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন , সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণ ও পল্লি উন্নয়নে অবদান রাখায় বেগম রোকেয়া পদকে ভ’ষিত করা হয়েছে।
নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)-এর মাধ্যমে ৮৬ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ঢাকা মহানগরীতে ১০ টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ,৬৩ টি জেলা শহরে ৬৩ টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ২টি উপজেলায় ২ টি প্রশ্ক্ষিণ কেন্দ্রসহ মোট ৭৫ টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে শহর অঞ্চলের দরিদ্র, দুস্থ ও বিত্তহীন ৪৫,০০০ জন মহিলাকে ১০ টি বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।এ ছাড়া প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের দ্বারা তৈরি পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা শহরে একটি বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই