জাগ্রত হোক বিবেক জয় হোক মানবতার

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ১১:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার:

নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, ক্ষুধা, বাস্তুচ্যুত-এমন মর্মান্তিক বিশেষণগুলো যেন এখন শুধু গাজার জন্যই বরাদ্দ। গত বিশ মাস ধরে নারী-শিশু নির্বিশেষে উপত্যকাটির মানুষের ওপর চলছে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। গাজায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলছে তা একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে হজম করা বেশ কঠিন। এমন হৃদয়বিদারক চিত্র একটি-দুটি নয়। হাজার হাজার। যা করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট ইসরাইল। লাখ লাখ মানুষ সেখানে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। যাদের খাদ্য নেই, থাকার জায়গা নেই। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেই। এক অমানবিক ও মর্মান্তিক জীবন পার করছেন গাজাবাসী। তারা যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। এ পর্যন্ত কতো মানুষ নিহত হয়েছেন তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। প্রতিনিয়তই মৃত মানুষের মিছিল ভারী হচ্ছে। দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্লাস্টিকের বেসিন হাতে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে একটু স্যুপের আশায়। এই করুণ দৃশ্য আজ গাজার বাস্তবতা। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, খাদ্য সংকট এবং মানবিক সহায়তার অভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের জীবন পরিণত হয়েছে বেঁচে থাকার এক কঠিন সংগ্রামে। পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন গাজার জাবালিয়া সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে ছুটে যান খাবারের খোঁজে। তাদের এই যুদ্ধ শুধু খাদ্যের জন্য নয়, জীবনের জন্য, একটু বেঁচে থাকার জন্য। যুদ্ধ তাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। একটি রান্নাঘরের সামনে স্যুপের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা এখন তাদের প্রতিদিনের কাজ।সামান্য একটু ডালের স্যুপ পেলেই মহা খুশি তারা। সেটা দিয়েই কোনো রকমে পরিবারের তিনবেলার খাবারের চাহিদা মিটিয়ে নেন তারা। আর যেদিন কিছুই পান না, সেদিন খালি পেটে ঘুমাতে যান। পরের দিন ভোরে উঠে আবার যান ট্রাকের কাছে। শুধুমাত্র একটু স্যুপের উদ্দেশ্য।

গত মার্চ মাসের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, চিকিৎসা ও জ্বালানি প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে ২.৩ মিলিয়ন মানুষের বসবাসকারী গাজায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজাকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে বলে উল্লেখ করেছে। চাপের মুখে কিছু ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পেলেও সেগুলোর বেশিরভাগই মানুষের হাতে পৌঁছায়নি।গাজায় শুধু ক্ষুধাই নয়, প্রতিদিন চলছে নতুন করে ইসরায়েলি বোমা হামলা। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে ৫৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষ।এই সংখ্যার মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও নারীও রয়েছেন। ইসরায়েলের নিকটতম মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এখন কিছুটা সমালোচনামূলক মনোভাব নিচ্ছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন বলেছে, গাজার পরিস্থিতি অসহনীয়। তবে এসব বিবৃতি ফিলিস্তিনিদের জন্য তেমন কিছু পরিবর্তন আনছে না। ইসরায়েল বলছে, তারা সাহায্য আটকাচ্ছে যাতে তা হামাসের হাতে না পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই নীতির কারণে গাজার মানুষ খাদ্য সংকটে পড়ছেন,এবং অসহায় শিশুদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো একটি রুটিও তাদের হাতে থাকছে না। রাজনৈতিক বিবৃতি, সামরিক কৌশল কিংবা কূটনৈতিক সংঘাতের বাইরে গাজার সাধারণ মানুষদের চাওয়া খুবই সাধারণ-তারা শুধু বেঁচে থাকতে চায়।গাজার হাজার হাজার মানুষের মুখে একই কথা, আমরা কিছু চাই না। শুধু একটু খাবার, একটু নিরাপত্তা চাই। যেন আমাদের সন্তানরা অন্তত ক্ষুধায় না মরে। তাদের এই আর্তনাদ শুধু গাজার মানুষের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকেত। যুদ্ধ কেবল সামরিক নয়, এটি মানুষের আশা, জীবনের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। আজ যখন বিশ্ব রাজনীতি গাজাকে ঘিরে নানান হিসেব কষছে, তখন গাজার মানুষের প্রশ্ন,‘আমার সন্তানের ক্ষুধার জন্য দায়ী কে?’ মানবতা আজ গাজার শিশুদের কান্নার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছে না। এটি সমগ্র পৃথিবীর নৈতিক ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, ইসরাইলি বাহিনীর বোমার আঘাতে যেসব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে তার নিচে যেসব মানুষ চাপা পড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। আহতের সংখ্যা লক্ষাধিক।গাজার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেভাবে তুলে ধরা হয় তার চেয়েও বেশ ভয়াবহ। তারা যে শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হচ্ছে তেমন নয়, কিছু মানুষকে চিহ্ন হিসেবে জীবিতও বাঁচিয়ে রাখছে। যাদের শরীরে রয়েছে ইসরাইলি হায়েনাদের বর্বরতার দাগ। এসব নির্যাতনের বর্ণনা এতটাই লোমহর্ষক, যা সকলের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, কীভাবে তাদের সেখানে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্লজ্জ ইসরাইল বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিদের শরীরে থাকা নির্যাতনের চিহ্নই সাক্ষ্য দিচ্ছে নেতানিয়াহুর বাহিনীর বর্বরতা কতোটা নির্মম। নির্যাতিত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাদেরকে হামাসের সদস্য সন্দেহে আটক করা হয় এবং অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন ৭ই অক্টোবরের হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। তবুও তাদের ওপর অত্যাচার করে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঢেলে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। সম্প্রতি এক যুদ্ধবিরতির চুক্তির মাধ্যমে ওই বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে তেল আবিব। কেউ কেউ বলেছেন, শুধু গাজার অধিবাসী হওয়াই নাকি তাদের বড় অপরাধ। এর জেরে তাদের মেরে মেরে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেকে বলেছেন, এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল। এসব অভিযোগ যাচাই করার জন্য ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) চিঠি দিয়েছে বিবিসি, তবে তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এর তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা বলেছে, এভাবে কারাগারে আটক করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণ বেআইনি। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা ইসরাইলি মানবাধিকার সংগঠন বি’তসেলেম এবং জাতিসংঘের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারের সঙ্গে মিলে যায়।

জাতিসংঘ গত জুলাই মাসে ইসরাইলি কারাগার থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং তা প্রকাশ করে দেয়।যেখানে বলা হয়েছে, আটককৃত ফিলিস্তিনিদের উলঙ্গ করে তাদের শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। সিগারেট খেয়ে সে আগুন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের শরীরে ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে। আর খাবার ও ঘুম কেড়ে নেয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নারী বন্দিদের ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো। হিংস্র কুকুরগুলো বন্দিদের ওপর উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের শরীরের অংশ ছিঁড়ে ফেলতো, যা দেখে উপহাস করেছে ইসরাইলি সেনারা। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বেশ কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এটি আইডিএফের হুমকি প্রদানের একটি বিশেষ পদ্ধতি। যার নাম স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম। তবে ইসরাইল এগুলো কখনোই স্বীকার করেনি। গাজায় আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়ার সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল। প্রকৃতপক্ষে গোটা গাজাই এখন কারাগারে পরিণত হয়েছে। যেখানেই মানুষের জটলা সেখানেই বোমা ফেলছে ইসরাইল। বোমার আঘাতে শিশুদের মাথা, হাত-পা শরীর থেকে আলাদা হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ ছাড়া গাজার সীমান্তগুলো দখলে রেখেছে নেতানিয়াহুর বাহিনী। যার ফলে উপত্যকাটিতে কোনো খাবারই প্রবেশ করতে পারছে না। নেই বিশুদ্ধ পানি। তীব্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মৃত্যুর সময় গুনছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি।ইসরাইলের বর্বরতায় সবচেয়ে বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে শিশুরা। এমনও হয়েছে, জন্ম নিয়েই বোমার আঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে বহু শিশুর। আস্ত একটি সভ্যতাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। গাজার অধিকাংশ স্থাপনাই এখন ধ্বংসস্তূপ। যেসব অঞ্চলকে নিরাপদ জোন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সাম্প্রতিক সেখানেই হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। কার্যত গাজাবাসীর কোনো আশ্রয়স্থল রাখেনি তারা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও, ক্ষমতায় বসার পর তা উল্টে গেছে। তিনি গাজাকে তার রিয়েল স্টেট প্রপার্টির স্বর্গরাজ্য বানানোর অভিলাস প্রকাশ করেছেন। আর গাজাবাসীকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার কথা জানিয়েছেন। যদিও বেশ কিছু আরব বিশ্ব এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্পের ওই অভিলাস বাস্তবায়ন হবে না। জীবন থাকতে মাতৃভূমি না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে গাজাবাসী। এদিকে ইউরোপের সঙ্গে রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা বিরোধ দেখা দেয়ায়, তারা হয়তো গাজার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার রাজনীতি শুরু করেছে। যার উদাহরণ হচ্ছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সাম্প্রতিক বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে তার দেশ। যুদ্ধের এতদিন পর এসে এভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে সুর তোলায় সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। যত যাই হোক শেষ পর্যন্ত গাজাবাসীর ভাগ্যে কী আছে তা এখনই বলা কঠিন। তবে বিশ্ববাসী গাজার গণহত্যা দেখছে এবং উপলব্ধি করছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার পিছনেও অনেক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইসরায়েল ও তার মিত্ররা হামাস নির্মূল অভিযানের নামে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করছে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ইসরায়েল গাজাকে ৫৬ বছর ধরে সামরিকভাবে দখল করে রেখেছে এবং ১৬ বছর ধরে অবরোধ করে রেখেছে, যা অমানবিক ও হৃদয়বিদারক। বিশ্ববাসী উপলব্ধি করছে যে, ফিলিস্তিনে নজিরবিহীন ও অমানবিক গণহত্যা চলছে। এই ঘটনা বিশ্বকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে নিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের মানবতা পুনরুদ্ধার করা এবং জন্মভূমির অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া অপরিহার্য। অবিলম্বে ফিলিস্তিনে এই গণহত্যা বন্ধ হওয়া উচিত। ফিলিস্তিনিদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। ফিলিস্তিনে যে গণহত্যা হচ্ছে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খারাপ বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে। বিশ্ববাসীকে আর নীরব বসে থাকার সময় নেই। ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে এখনই বিশ্ববাসীকে জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান করতে হবে।


লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।