আইনের শাসন নিশ্চিত করতে দলীয় পরিচয় নয়, অপরাধই মুখ্য
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ
জামিল হোসেন

আইনের শাসন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। এ শাসন ব্যবস্থা তখনই কার্যকর হয়, যখন আইনের চোখে সবাই সমান হয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কোনোরকম পক্ষপাত বা দলীয় বিবেচনা পরিচয় কাজ করে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এই নীতির বাস্তবায়ন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীর পরিচয়ের চেয়ে তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এতে করে বিচার ব্যবস্থায় পক্ষপাতের অভিযোগ উঠে এবং আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
যে রাষ্ট্রে আইনের শাসন নেই, সেখানে প্রকৃত শান্তি ও স্থিতিশীলতা কখনোই আসতে পারে না। একজন সাধারণ নাগরিক অপরাধ করলে যদি দ্রুত বিচার হয়, অথচ রাজনৈতিক পরিচয়ধারী কোন ব্যাক্তি একই বা আরও গুরুতর অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যায়, তবে তা শুধু অন্যায় নয়, রাষ্ট্রের প্রতি অবিচারও বটে। এতে সমাজে এক ধরনের 'দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা' গড়ে ওঠে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়।
রাজনৈতিক দল কিংবা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ছায়াতলে থেকে কোনো ব্যক্তি যদি অপকর্ম করে, আর সেই অপরাধকে আড়াল করতে গিয়ে দলীয় পরিচয় ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। এটি কেবল অপরাধীকেই উৎসাহ দেয় না, বরং অপরাধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। অপরাধী যখন বুঝে ফেলে—ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেই সে আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে—তখন সমাজে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বিলীন হয়ে যায় এবং অপরাধীর অপরাধের দৃঢ়তা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। বিচার না পেয়ে তারা হতাশ হয়ে পড়ে, আইনের শরণাপন্ন হওয়ার আগ্রহ হারায়। এতে করে সমাজে আত্মীয়তা, ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা পেশিশক্তির কাছে আইন পরাজিত হয়। আর এই পরাজয়ের দায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনিক কাঠামোর উপরও পড়ে। এতে করে সমাজের শান্তি বিনষ্ট হয় এবং অপরাধ বাড়তে থাকে।
তাই সময় এসেছে আইনের শাসনের প্রশ্নে 'দলীয় পরিচয়' নয়, 'অপরাধ'কেই মুখ্য বিবেচনা করার। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নয়, তার অপরাধ কতটা গুরুতর, সেটাই বিবেচনা হওয়া উচিত। প্রয়োজনে নিজ দলের লোক হলেও যদি সে অপরাধে জড়িত থাকে, তাহলে তাকেও আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে—এমন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন আইন প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যদিকে জনগণের আস্থাও ফিরবে।
রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা-এই তিনটি বিষয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দল, কেউ যেন অপরাধীকে রক্ষা করার চেষ্টা না করে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখা এবং তার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করাই হবে একটি সভ্য রাষ্ট্রের পরিচয়।
আইনের শাসন মানে কেবল সংবিধানে লেখা কিছু ধারা নয়, বরং এটি বাস্তবে প্রয়োগ করার বিষয়। আর এর জন্য অপরাধীর পরিচয়ের আগে অপরাধকেই গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই আমরা পাবো একটি ন্যায়ভিত্তিক, নিরাপদ ও সুবিচারপূর্ণ সমাজ।
লেখক : জামিল হোসেন, অনলাইন নিউজ এডিটর, দৈনিক আমার বার্তা, ঢাকা।
আমার বার্তা/জেএইচ