প্রস্তাবিত বাজেটে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত নেই: বিএনপি
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১৪:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

সংলাপের মধ্য দিয়ে বাজেট হলে তা বাস্তবসম্মত হতো বলে মনে করে বিএনপি। ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাজেট হলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত বলেও মনে করেন দলটির নেতারা।
বুধবার (৪ জুন) রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এসব কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে নূন্যতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাজেট তৈরি করতে পারতো অন্তর্র্বতী সরকার। বিশেষ পরিস্থিতিতে বাজেট নিয়ে সংলাপ প্রত্যাশিত ছিল।’
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি বড় নীতিনির্ধারণী উপলক্ষ্য। পতিত স্বৈরাচারি সরকার অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ন্যায্য ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। জনগণের জীবনযাত্রার অগ্রাধিকার। এ কারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
আমির খসরু বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সনের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রাম। বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। বাজেট রাজনৈতিক সরকারের জনগণ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়ন কাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ম্যাগনা কার্টা’ কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। যুক্তরাজ্যে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ কর ও ব্যয়ের উপর সংসদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়’- এই স্লোগান আমেরিকান বিপ্লবের ভিত্তি।
তিনি বলেন, আমরা এক যুগান্তকারী নজির তৈরি করতে বিএনপি সর্বক্ষেত্রে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্র্বতীকালীন সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নূন্যতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার চাইলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ করতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত এই বাজেট। কিন্তু সে সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হত না। নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংলাপ আরও জরুরি ছিল। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ বাজেটীয় বছরের মধ্যেই নির্বাচিত সরকার আসবে। ওয়েস্টমিনস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী অনেক দেশেই ‘অন্তর্র্বতীকালীন শাসন সংক্রান্ত রীতিনীতি’ আছে, যা বাংলাদেশে নাই। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হলে বা নতুন সরকারের সম্ভাবনা থাকলে বাজেট অনুমোদনের ভিন্ন পন্থা থাকে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার নীতি-কাঠামোর বড় ধরণের পরিবর্তন করে না। উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতিও দেয় না।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংলাপ হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দে বাস্তবসম্মত পুনর্বিন্যাস হত। স্বৈরাচারি সরকারের সীমাহীন জনবান্ধবহীন নীতি-কাঠামো উদ্ভূত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহের সংকট থেকে মুক্তির দিক নির্দেশনা থাকত। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ডবল ডিজিট, তা কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করার কথা বলা হচ্ছে, যা বাস্তবসম্মত মনে হয় না। দারিদ্র বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে- এমন দাবি করে তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এসময়ে দেশে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ্য হ্রাস পেয়েছে।
বিবিএসের হিসাব মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সেটা এবারের বাজেটে ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পূর্বের সরকারের মতোই অবাস্তব এবং কাগুজে প্রবৃদ্ধি। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হল না।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক বলে ও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, কৃষিতে দেওয়া হয়েছে বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, শিক্ষায় ১৪ শতাংশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ ও স্কুলগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা যেত। আমাদের সময় ইনশাআল্লাহ শিক্ষার এ সকল ক্ষেত্রকে পূণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা হবে।
বিএনপি নেতা বলেন, বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ আসে ৯৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। সেটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছে না। তাই ডিএফআই নাই বললেই চলে। বাজেটও এ ব্যাপারে একেবারেই নিরব।
অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাগুলোর সমাধানে সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রয়োজন ছিল দাবি করে তিনি বলেন, প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল- বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ-নকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্প কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সঙ্গে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।
তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বাড়ানোয় ডিজিটাল উদ্যোক্তারা চাপে পড়বেন। এই খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডিজিটাল রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তরুণ উদ্যোক্তাদের হতাশা বাড়বে। উদ্ভাবনও নিরুৎসাহিত হবে।
আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি দাবি করে খসরু বলেন, পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মতো পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হতো। সরকার ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে।
সংবাদ সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বেগম সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ ও বিএনপি অর্থ-বিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী খালেদ মাহবুব শ্যামল।
আমার বার্তা/এমই