ভারতীয় মিডিয়ায় হাসিনার একই রকম ৮ সাক্ষাৎকার: সাংবাদিকতা নাকি পিআর
এসএনএম আবদির বিশ্লেষণ
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

ভারতের গণমাধ্যমে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একযোগে প্রচারিত সাক্ষাৎকারগুলোকে ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, রাজনৈতিক বার্তা এবং আঞ্চলিক শক্তির পালাবদল—সবকিছুই নতুন করে প্রশ্নের মুখে এসেছে তার সাজা ঘোষণার আগ মুহূর্তে।
ভারতের আউটলুক ইন্ডিয়ার সাবেক উপ-সম্পাদক ও স্বাধীন সাংবাদিক এসএনএম আবদি তার বিশ্লেষণে বিষয়টি খতিয়ে দেখেছেন। তার এই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিভিন্ন দিক—
হাসিনার রায়ের আগে ভারতে ‘সমন্বিত’ সাক্ষাৎকার ঝড়
গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনাকে ১ হাজার ৪০০ আন্দোলনকারীর হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে অনুপস্থিত অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড রায় দেয়। এর ঠিক আগের ১২ দিনের মধ্যে ভারতের আটটি বড় গণমাধ্যম প্রায় একই প্রশ্নোত্তরভিত্তিক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে।
এগুলোর মধ্যে ছিল—
● দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
● দ্য হিন্দু
● হিন্দুস্তান টাইমস
● টাইমস অব ইন্ডিয়া
● নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
● আনন্দবাজার পত্রিকা
● প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই)
● এনডিটিভি অনলাইন
প্রতিটি গণমাধ্যমই সাক্ষাৎকারটিকে এক্সক্লুসিভ বলে দাবি করলেও প্রশ্ন ও উত্তর প্রায় হুবহু মিলে যায়। আবদির ভাষায়, এগুলো একই কাপড়ের তৈরি–এ যেন স্বাধীন সাংবাদিকতা নয়, বরং সুপরিকল্পিত গণসংযোগ অভিযানের ফল। অজানা স্থানে বসে সাক্ষাৎকার দেওয়ার দাবি পুরো ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
আবদির মতে, সময় ও ভাষার সমন্বয় ইঙ্গিত দেয় পেশাদার এবং ব্যয়বহুল একটি পিআর কৌশল কাজ করেছে।
বার্তা স্পষ্ট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনুপস্থিত
সাক্ষাৎকারগুলোতে হাসিনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর দায় চাপান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের (ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে) বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কার্যক্রমের অভিযোগ তোলেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন অনাথ, ইসলামী উগ্রবাদের পুনরুত্থান ঘটছে, এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে প্রহসনের, কারণ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ।
কিন্তু আবদির মতে যা প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যা প্রকাশিত হয়নি। তিনি কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো যে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকই করতেন, যেমন—
● ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি কে দিয়েছিল?
● তিনি কি নরেন্দ্র মোদী বা ভারতের নিরাপত্তা নেতৃত্বের সঙ্গে গোপনে দেখা করেছেন?
● তার অস্থায়ী অবস্থান কেন ১৫ মাসের বেশি দীর্ঘ হলো?
● তিনি কি যুক্তরাজ্যসহ অন্য কোথাও আশ্রয় চাইছিলেন?
● তার সরকার পতনের সময় দিল্লি কী পরামর্শ দিয়েছিল?
এসব প্রশ্ন অনুপস্থিত থাকাকে আবদি বলেছেন চোখে পড়ার মতো সাংবাদিকের ব্যর্থতা।
ঢাকায় কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
১১ নভেম্বর, ভারতের গণমাধ্যমে এ সাক্ষাৎকারের ঢল নামার পর বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনারকে তলব করে। অভিযোগ ছিল– একজন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে ভারত সাক্ষাৎকার দিতে সহায়তা করেছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন আন্তর্বর্তী সরকারের মুখপাত্র শফিকুল আলম ভারতীয় সাংবাদিকদের বুটলিকার বলে মন্তব্য করেন। ভারতের প্রেস ক্লাব তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ক্ষমা দাবি করে, যা পরে বিতর্কে রূপ নেয়।
বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য
আবদির মতে, এ ঘটনাটি শুধুই মিডিয়া–কৌতূহল নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় শক্তিগুলোর টানাপোড়েনের মাঝখানে হাসিনা এখন এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়েছেন।
তার ভাষায়—হাসিনা সাধারণ কোনো নির্বাসিত নেতা নন; তার ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িত।
তিনি নিকারাগুয়ার সাংবাদিক ফ্যাব্রিস লে লুসের কাজ উল্লেখ করে বলেন—প্রশ্নোত্তরের সাক্ষাৎকার সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে ওঠা উচিত, প্রচারণামূলক কনটেন্ট নয়।
সাংবাদিকতা নাকি বয়ান-ব্যবস্থাপনা?
আবদির মতে— এই সাক্ষাৎকারগুলো সাংবাদিকতার গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করেনি; বরং জনমতের কাছে একটি নির্দিষ্ট বয়ান পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসাবে কাজ করেছে।
তার কথায় এগুলো ছিল গণপরীক্ষা নয়, গণসংযোগ। এসব সাক্ষাৎকারকে তিনি সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রম হিসাবে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ যখন উত্তপ্ত নির্বাচনি বছরে প্রবেশ করছে, হাসিনাকে ঘিরে ভারতের গণমাধ্যমের এই অস্বাভাবিক সমন্বয় দেখিয়ে দিচ্ছে—তিনি এখনো আঞ্চলিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন এবং তাকে ঘিরে বয়ান ও পাল্টা-বয়ানের লড়াই এখনো তীব্র।
