সিডিসি প্রদানে নিষেধাজ্ঞা

লোকসানে ফেলেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর

প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৪:৪৫ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

  •    বছরে ৬০০ মিলিয়িন ডলার হারাচ্ছে সংস্থাটি
  •    বিদেশি জাহাজে বাংলাদেশি নাবিকরা পরিত্যাজ্য


আপন ভালো পাগলে বুঝলেও বুঝতে পারছে না নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর! তাইতো সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) সনদে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে সংস্থাটি প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে।

সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের শত শত সিডিসি সনদধারীরা চাকরি না পাওয়ায় বছরে এই বিপুল পরিমাণের অর্থ হাতছাড়া হচ্ছে। সরকারকে এই লোকসানে ফেলেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

তবে তাদেরকে নিয়োগ না দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দানের বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ায় সিডিসি প্রদান স্থগিতাদেশ দিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রুলের বিরুদ্ধে জবাব দেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।

সংস্থার কর্মকর্তা (পদ-ক্যাপ্টেন পদধারী) মো. গিয়াসউদ্দীন আহমেদ নিজের অপকর্ম এবং দুর্নীতি ঢাকতে তিনি এক অভিনব চাল চালেন। যেখানে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) আমিনুর রহমান ও জাহাজ শাখার উপসচিব আলী আহসান, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক এবং সংসদীয় কমিটির উপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে সৎ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। যেখানে  তিনি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন।

একই সাথে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন দুর্নীতির সাক্ষী স্পেশাল ব্যাচ ও পানামা সিডিসি ফাইল গায়েব করে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের এমন বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। যখন প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অগ্রসরমান সেখানে তার এরই অপকর্ম নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ গিয়াসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তরে ডিজিকে লিখিত অভিযোগ দাখিল করার ঘটনা ঘটেছে।

এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ নজরুল ইসলাম নামে এক  নাবিক এবং বাংলাদেশ সিমেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত ২৭ মে স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারি করে এবং এদের সিডিসি প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা যায় তিনি অফিসে নাই। চট্টগ্রামে জরুরি কাজে আছেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ডিজি স্যার এ বিষয়ে জানেন তবে সরকার কোনো মামলায় পরাজিত হলে তার বিরুদ্ধে নিয়ম মাফিক আপিল করতে হয়। সেটাই করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আইনের বিধান মানা হয়নি। সরকারি কোনো কর্মকর্তা নিজে কোনোভাবেই বাদী হতে পারেন না। আমাদের আইন কর্মকর্তা রয়েছেন তিনি পদাধিকার বলে বাদী হবেন এটিই বিধান। তবে এ অধিদপ্তরে কেবল গিয়াসউদ্দিন একাই দুর্নীতিবাজ এমনটি নয়। আরো অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে জড়িত।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে সিডিসি প্রদান করার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। যেখানে টাকার বিনিময়ে অদক্ষ ব্যক্তিদেরকে সিডিসি প্রদান করা হয়ে থাকে। বিষয়টি জানাজানি হলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এ ঘটনা দ্রুত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ডিজিকে নির্দেশ দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে প্রি-সী স্পেশাল রেটিং কোর্স নামে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোনো কোর্স না থাকা সত্ত্বেও এবং অনাবাসিক প্রি-সীর স্পেশাল রেটিং কোর্স ২০২৩ চালু করে সম্পূর্ণ নীতিমালা বহির্ভূতভাবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ২০০ জন অযোগ্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ্যে আসে। যেখানে প্রত্যেকের কাছে ৭ লাখ টাকা করে প্রায় ১৪ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ে। দুর্নীতির এই ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে যার নম্বর ৪৭৭/২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ডি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের দ্বৈতবেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতের আদেশ লঙ্ঘিত হওয়ায় সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন, তার একান্ত সহযোগী চট্টগ্রাম সরকারি শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলায় নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নৌ সচিব, নৌপ্রতিমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে তদন্ত করে এর প্রতিবেদন চাওয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তদন্তের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম সিডিসিকে বাসায় লোক পাঠিয়ে নানাভাবে ভয় ভীতি প্রদর্শন করে বিচারকে ভিন্নখাতে নেয়ার চক্রান্ত আঁটে। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো রিটে কার্যপত্রে বলা হয়, সরকারি এবং সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে রেটিং কোর্স উত্তীর্ণ কয়েক হাজার নাবিক চাকরি পাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন নৌপরিবহন অধিদপ্তরে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে যোগদানের পর থেকে দুর্নীতিবাজ শিপিংমাস্টার জাকির হোসেনকে সাথে নিয়ে নীতিমালা পাশ কাটিয়ে জন প্রতি ৮ লাখ টাকা নিয়ে ১২৭ জনকে অবৈধ পন্থায়, আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল পানামা সিডিসি’র অনুকূলে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করেন। সেখান থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা দুর্নীতির  মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়। এসব ভুয়া পানামা সিডিসি প্রাপ্তরা বিভিন্ন শিপিং এজেন্টকে টাকা দিয়ে জাহাজে উঠার পর ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে পালিয়ে যেয়ে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করে। ফলে জাহাজ মালিকদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়। এরপর জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজে বাংলাদেশি নাবিক নেয়া নিষিদ্ধ করে। কিছু নাবিক জাহাজে চাকরি করলেও তাদের কাজের মান খারাপ হওয়ায় জাহাজ মালিকরা পরবর্তীতে বাংলাদেশি নাবিকদের অদক্ষ বিবেচনায় নিষিদ্ধ করে। এজন্য সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সুযোগ পেয়ে ও প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে সিডিসি প্রাপ্ত যোগ্যরা বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে চাকরির সুযোগ হারাচ্ছে। এভাবে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা হারানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে ২০০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদন বিহীন অনাবাসিক প্রি-সীর স্পেশাল রেটিং কোর্স।  তারা ২০২৩ এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করে। যেই আবেদনের মাধ্যমে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা স্বীকৃত কোনো ইনস্টিটিউট নয়। এদিকে ২০০ জন নাবিক বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জাহাজে চাকরিরত আছেন বা ছিলেন। গত ২৭ মে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারি করে এবং এদের সিডিসি প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়াস উদ্দিন নিজের স্বার্থে হাইকোর্টের ভ্যাকেশন চলাকালীন গঠিত একটি একক বেঞ্চে এই রুলনিশির বিরুদ্ধে মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়াই রিট করে।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দীন আহমেদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। অধিদপ্তরে আমার শত্রু নেই সে কথা বলা যাবে না। যারা তার উন্নতি পছন্দ করেনা তারা নানাভাবে তাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি সুকৌশলে তার দুর্নীতির প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।


আমার বার্তা/জেএইচ