বৃষ্টির পানিতে ডুবলো ঢাকা
জনজীবনে দুর্ভোগের থাবা
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ | অনলাইন সংস্করণ
পারভেজ খান
চলছে আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহ। আকাশ ভেঙে রিমঝিম বা ঝুমবৃষ্টি নামবে এমনটাই স্বাভাবিক। গত কদিন ধরেই চলছিলো ভ্যাপসা গরম। গতকাল শুক্রবার আবার ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। রাজধানীবাসীর একটা অংশ ছিলেন ঘরেই। অনেকে ছিলেন ঘুমে। সাতসকাল মানে ভোর ৬টার দিকেই আকাশে মেঘ ভেঙে মাটিতে নেমে পড়তে শুরু করে বৃষ্টি। কখনও টানা কখনও হালকা মাত্রার বিরতি দিয়ে চলে ৬ ঘণ্টা। আর এই ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টির রেকর্ড দাঁড়ায় ১৩০ মিলিমিটার। তলিয়ে যায় পুরো ঢাকা। সাপ্তাহিক এই ছুটির দিন যারা ঘর থেকে বের হননি, তারা কেমন ছিলেন সেটা বলা যাবে না। তবে যাদের ঘরের বাইরে বের হতে হয়েছে তারা পড়েছেন সীমাহীন ভোগান্তিতে। একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে পানিবন্দি জীবন। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি। অনেক এলাকাতেই ছিলো না যানবাহন। পথে বের হওয়া জনজীবনের ওপর দুর্ভোগের থাবা সত্যিকার অর্থেই গতকাল অসহনীয় আর বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। আবহাওয়া অফিস বলছে, মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এই বৃষ্টি বেড়েছে। আর জলাবদ্ধতা হয়েছে পানি বের হওয়ার ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে।
ঢাকায় গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে টানা বৃষ্টি। তখনই মূলত বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এরপর বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে থেমে থেমে বৃষ্টি। ভারী বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট হয় এই জলাবদ্ধতা। অবশ্য এই পানি নিরসনে গতকাল দুপুর থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ শুরু করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
ভ্যাপসা গরমে এই বৃষ্টিতে জনজীবনে কি কোনো শীতল স্বস্তি নিয়ে এসেছে ? না। ভ্যাপসা গরম রয়েই গেছে। বৃষ্টি তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারেনি, পারেনি ভিজিয়ে শীতল করতে।
বৃষ্টির ফলে রাজধানীর কোনো এলাকা তলিয়ে যায়নি এটা বলা যাবে না। কমবেশি সবখানেই জমেছে পানি। উঁচু এলাকা হাতিরঝিলের কিছু অংশও কাল তলিয়ে যায়। তবে মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, মোহাম্মদপুরের আংশিক, ইসিবি, লালবাগ, আজিমপুর, নিউমার্কেট, মালিবাগ, শান্তিনগর, মিন্টো রোড, বেইলী রোড, হেয়ার রোড, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও এর চারপাশ, সেগুন বাগিচা, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তা, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডসংলগ্ন এলাকা, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কের জলাবদ্ধতা ছিলো স্মরণীয়।
রাস্তাগুলো পানি ভরাট থাকায় অনেক এলাকায় যানবাহন চলছে মন্থরগতিতে। কোনো কোনো এলাকায় যান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। চলার পথে পানিতেও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক গাড়ি। চলেনি রিকশাও। দুই চারটা যদিও বা মিলেছে ভাড়া চার-পাঁচগুণ বেশি। সব মিলিয়ে এক কথায় এই জলমগ্নতার ফলে পুরো মহানগর জুড়ে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়, স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন, নগরবাসী পড়ে প্রচণ্ড দুর্ভোগে।
আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, গতকাল সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ছয় ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩০ মিলিমিটার। এটা চলতি বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক অবস্থায় রাজধানীতে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ফকিরেরপুল, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, তোপখানা রোড, মৎস্যভবন, কারওয়ানবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ মোড়, আরামবাগ, প্রগতি সরণি, নিউমার্কেট, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, মিরপুরে রোকেয়া সরণি, পুরোনো ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড়, বংশাল, নিমতলীর টোয়েনবি সার্কুলার রোড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
আবহাওয়া বিভাগের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির এই প্রতিবেদককে বলেন, নিয়ম অনুসারে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর বৃষ্টিপাতের পরিমাপ করা হয়। ভোর ছয়টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। পরের তিন ঘণ্টায় পরিমাণ আরো বেড়েছে। সকল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। সব মিলে ছয় ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড ১৩০ মিলিমিটার। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় গত ২৭ মে রাজধানীতে একদিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল ২২৪ মিলিমিটার। অবশ্য সেটা মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টি ছিলো না, ছিল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবজনিত বৃষ্টি।
তিনি আরো বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজারে ৩০৯ মিলিমিটার। এ ছাড়া সন্দ্বীপে বৃষ্টি হয়েছে ২১৯ মিলিমিটার, সীতাকুণ্ডে ১০২ মিলিমিটার। মৌসুমি বায়ু অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকার কারণেই এই ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা আরো অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন থাকবে। তবে আজ শনিবার থেকে অতিমাত্রার সক্রিয়তা কমে আসবে। ফলে মাঝে মাঝে হালকা বা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেও ভারী বর্ষণ হবে না।
গতকালের বৃষ্টিতে পুরোনো ঢাকায় পানি জমেছে সবচেয়ে বেশি। নাজিরাবাজার ও কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাঁটু পানি। বংশাল রোড, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতিবাজার নবাবপুর রোডে বয়ে গেছে ঘোলা পানির স্রোত। তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু ধোলাইখাল রোডটিও পানিতে তলিয়ে গেছে। নিমতলী, চানখাঁরপুল এলাকা ছিলো পানির তলে। এর ফলে মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের ওঠা-নামার মুখে লম্বা যানজট সৃষ্টি হয়। একই অবস্থা দেখা গেছে হাজারিবাগ মোড় থেকে ট্যানারি মোড়ের দিকের সড়কে। হাজারীবাগ নতুন রাস্তাটির কাঁচাবাজার মোড় থেকে উত্তর দিকে সিঙ্গারের তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত পুরোটাই হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয়দের মতে, পুরান ঢাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইনগুলো থেকে ময়লা পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে না।
রাজধানীর পুরো গ্রিনরোডেও পানি জমে। কমফোর্ট হাসপাতাল থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতাল পর্যন্ত সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। এখানে হাসপাতালগুলোতে রোগী নিয়ে যাতায়াত করতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে লোকজনের। পানি জমেছে সেন্ট্রাল রোড ও কলাবাগান এলাকায়। কলাবাগানের আবেদ আলী ঢাল এলাকার অনেক বাড়ির নিচতলা ও দোকানের ভেতরে পানি ঢুকেছে।
কাঁটাবন মোড় থেকে বাটার মোড় হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় পর্যন্ত এলিফ্যান্ট রোডে পানি জমে। ওদিকে নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট হয়ে নীলক্ষেত অবধি সড়কে পানি। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কল্যাণপুর প্রধান সড়ক। ধানমন্ডির সোবহানবাগ থেকে, রাপা প্লাজার সামনে, ২৭ নম্বর সড়কের বেশ খানিকটা হয়ে আসাদগেট পর্যন্ত পানি। চলার পথে গাড়ি আটকে গিয়ে এই সড়কে যানবাহন চলাচলই বন্ধ হয় গেছে। মানিকমিয়া অ্যাভিনিউ ছিলো পানির তলায়।
মিরপুরের বেশির ভাগ এলাকার সড়কেই পানি জমে। রোকেয়া সরণি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া , কাজীপাড়া, সেনপাড়া, দশনম্বর গোল চক্কর ও আশপাশের পুরোটাই পানির দখলে। পানি ঢুকেছে সড়কের দুই পাশের মহল্লাগুলোর ভেতরের অলিগলিতেও। মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে থেকে এক নম্বর মোড় পর্যন্ত হাঁটুপানি। টোলারবাগ এলাকার পশ্চিম অংশ পুরোটাই পানি আটকে যাওয়ায় লোকজন ঘর থেকেই বের হতে পারেন নি।
ডিআরইউ-প্রেস ক্লাব চত্বর: পানি জমেছে পুরো সেগুনবাগিচা এলাকায়। মৎস্যভবন থেকে কদমফুল ফোয়ারা হয়ে তোপখানা রোড পানির তলায়। জাতীয় প্রেস ক্লাব আর ডিআরইউ চত্বর পানিতে ডুবে গেছে। পুরো শান্তিনগর এলাকাই ছিলো পানির তলে। মালিবাগ মোড় থেকে শুরু করে কাকরাইল হয়ে সেগুনবাগিচার পুরো রাস্তাই তলিয়ে যায়। মন্ত্রীপাড়া হিসেবে পরিচিত হেয়ার রোড, মিন্টো রোড আর বেইলী রোডে ছিলো হাঁটু পানি।
আমার বার্তা/জেএইচ