বঙ্গবন্ধু পরিষদের নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর

দুর্নীতি আর অনিয়ম করে তারা গড়েছেন অঢেল সম্পদ

প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৪, ১৯:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ

  শাহীন আলম:

# বদলি থেকে পদায়ন, সবই হয় তাদের ইশারায়
# বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা পান ‘প্রাইস পোস্টিং’, ছড়ি ঘোরান নারকোটিকসে
# নিয়োগ হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো তালিকায়

দেশে মাদকের বিস্তার বা প্রসার রোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রধান ভূমিকা পালন করে। অথচ এই সংস্থারই নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অধিদপ্তরের সবকিছু হয় বঙ্গবন্ধু পরিষধের মাধ্যমে। ৩১ সদস্যবিশিষ্ট এই বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা ঠিক করে কাকে কোথায় বদলি করা হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করে এই পরিষদ। আর এর মাধ্যমে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন কর্মকর্তারা।  

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা কাউকে তোয়াক্কা করেন না। বেপরোয়া চলাফেরা করেন। এই চক্রটি এতটাই শক্তিশালী যে, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না। কেউ মুখ খুললেই তাকে বদলি করাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। আর যারা তাদের সঙ্গে সখ্য করে চলেন তাদের দেয়া হয় প্রাইস পোস্টিং। এরপর নিয়মিত মাশোয়ার নেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা। এছাড়াও পোস্টিংয়ের সময়ও নেয়া হয় এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা।

জানা গেছে, যেসব এলাকায় মাদক ও মাদকসেবী এবং মাদক কারবারি বেশি, মদের বার বেশিÑ সেসব এলাকায় মাদকের কর্মকর্তাদের অবৈধ আয় বেশি হয়। তাই ওই এলাকায় পোস্টিং পাওয়াকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ ভাষায় ‘প্রাইস পোস্টিং’ বলা হয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা দিনে দিনে হয়ে উঠছিলেন আরো বেপরোয়া। এ ছাড়াও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে নিয়োগ দেয়া হতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী। এরপর প্রতিটি নিয়োগে পাঁচ থেকে ১০ লাখ করে নিয়ে সেই টাকা বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা পৌঁছে দিয়ে আসতেন স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর ফার্মগেটের বাসায়। এ ছাড়াও কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ আয় থেকেও নিয়মিত মাসোহার দিতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ও প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক বিভাগীয় মামলা। যার মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়িতে আলোচিত পাঁচ কেজি হেরোইনের ভুল প্রতিবেদন দেয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এ ছাড়াও আট মাস আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে যৌথ অভিযানে একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে দুই কোটি টাকার হেরোইন জব্দ করা হয়। এরপর সেই হেরোইন ঢাকার গেন্ডারিয়ায় রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে সেখানে অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিয়েছেন ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা। প্রতিবেদন সরাসরি মাদক না লিখে তিনি লিখেছেন, ‘মাদকসদৃশ বস্তু পাওয়া গেছে।’ এভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদকের বড় চালানে ভুল ও অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ রয়েছে এই দুলাল কৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) আবুল হোসেন ছাত্রজীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আমুর হোসেন আমুর নিজ এলাকায় বাসিন্দা হওয়ায় তার সাথে রয়েছে গভীর সখ্য। তালিকায় নিচে থেকেও আমির হেসেন আমুর সুপারিশে এই আবুল হোসেন উপপরিচালক থেকে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন অতিরিক্ত পরিচালকের পদ। পরে আদালতে রিট দায়ের হলে তাকে পুনরায় আদালতের নির্দেশে ডিডি পদে ফেরত পাঠানো। বর্তমানে এই আবুল হোসেন আছেন রাজধানীতে মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপপরিচালক পদে। ঢাকা উত্তরের অধীনে মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরে রয়েছে একাধিক বিহারি ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প থেকে আবুল হোসেনকে নিয়মিত মাসোহার দিয়ে এখানে অবাধে চলে মাদক কারবার। রাজধানীর এসব ক্যাম্পে দিনে অন্তত শত কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। রাজধানীর কয়েকটি ক্যাম্পে প্রকাশ্যে সিরিয়াল দিয়ে মাদক বিক্রির অন্তত ডজনখানেক ভিডিও রয়েছে।

এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা গোয়েন্দা) মো. রবিউল ইসলাম। রবিউল চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময়েই কাটিয়েছেন রাজধানীতে। এই কর্মকর্তা সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন মানিকগঞ্জের মোহাম্মদ আতোয়ার রহমান যখন মাদকের ডিজি ছিলেন। তখন ঢাকা মেট্রো উত্তরে ডিডি ছিলেন। একই এলাকার হওয়ার সুবাধে এই কর্মকর্তা তখন ডিজির প্রভাব খাটিয়ে পোস্টিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। এই কর্মকর্তা তখন প্রধান কার্যালয়ে গেলে সবাই আতঙ্কে থাকতেন। যেদিন রবিউল সদর দপ্তরে যেতেন সেদিনই কোনো না কোনো কর্মকর্তাকে পোস্টিং করিয়ে দেয়া হতো। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নাম ভাঙিয়ে একই কায়দায় পোস্টিং বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের দপ্তর সম্পাদক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উত্তর) রাহুল সেন। ছাত্রজীবনে ছিলেন জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রাহুল দিনের বেশির ভাগ সময়েই কাটাতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বাসায়। মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে বদলি বাণিজ্য করে এই রাহুল সেন হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মন্ত্রীর সাথে তার এতটাই সখ্য ছিল যে, রাহুল সেনের বিয়েতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কাজকর্ম ফেলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের দ্বিতীয় কমিটির সহসভাপতি ও উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মেহেদী হাসান। ছাত্রজীবনে ছিলেন শহিদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি। চাকরি জীবনের শুরুতেই সহকারী পরিচালক (গভেষণা+প্রকাশনা) পদ থাকলেও তিনি ভাগিয়ে নেন সহকারী পরিচালক (লাইসেন্স) পদ। সদর দপ্তরে বসে সারা দেশের মদের বারের লাইসেন্সের দিতেন এই মেহেদী হাসান। প্রতিটি বার লাইসেন্সে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা করে নিতেন। এভাবে তিনি হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। পরবর্তীতে খন্দকার রাকিবুর রহমান মাদকের ডিজি হলে জড়িয়ে পড়েন বদলি বাণিজ্যে। চাকরি জীবনে মেহেদী হাসান একাধিক প্রাইস পোস্টিং পেয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে, ডিডি (গাজিপুর), ডিডি (বগুরা), এডি (ঢাকা গোয়েন্দা)। এ ছাড়াও অপর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপপরিচালক মো. হামিমুর রশীদ তার চাকরি জীবনের প্রায় ৯ বছর কাটিয়েছেন সদর দপ্তরে। এ ছাড়াও প্রাইস পোস্টিং পেয়ে মানকিগঞ্চে এক বছর ও সম্প্রতি ট্রান্সফার নিয়ে পটুয়াখালী আছেন। একইভাবে এই সিন্ডিকেটে জড়িত বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সংস্কৃতি সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক (স্টাফ অফিসার) শাহীন মাহমুদ। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের জয়েন সেক্রেটারি (১) ছিলেন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও উপপরিচালক (অপারেশন) মো. বজলুর রহমান শুরু থেকেই চাকরি করছেন সদর দপ্তরে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এই চক্রে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি কমিটির সভাপতি প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) আবুল হোসেন, সহসভাপতি ও উপপরিচালক মো. রবিউল ইসলাম, সহসভাপতি উপপরিচালক মো. বজলুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক রাহুল সেন, প্রচার সম্পাদব ও সহকারী পরিচালক শিরিন আক্তার। এ ছাড়াও চক্রে রয়েছেন বঙ্গবন্ধ পরিষদের অপর কমিটির সভাপতি ও উপপরিচালক (ঢাকা-গোয়েন্দা) রবিউল ইসলাম, একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপপরিচালক হামিমুর রশিদ, সহসভাপতি ও উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এই সংগঠনটি, এটি ঠিক নয়। সংগঠন আছে সত্যি, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে অবগত নন। তাছাড়া এখন তো এই সংগঠনের কোনো কর্যক্রম নেই আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে থাকারও কথা নয়। এদিকে মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এমন প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। 

 

আমার বার্তা/এমই