ইসলামে সামাজিক বৈষম্যের স্থান নেই
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৯ | অনলাইন সংস্করণ
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
ইসলামের অনন্য একটি বিষয় হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ মানবতাবোধ। ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে মানুষের কল্যাণচিন্তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ-তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, 'তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত; মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে।' (সুরা আল ইমরান : ১১০)। এ জন্য মানবতার কল্যাণে সব ধরনের বৈষম্যের মূলোচ্ছেদ করেছে ইসলাম ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত হলো নামাজ। আর জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে ধনী-গরিব, বাদশাহ-গোলাম, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকে না। সাম্য ও ঐক্যের ধারণাকে সামনে রেখেই সবাইকে কেবলামুখী হয়ে নামাজ ও কাবায় গিয়ে একই পোশাকে হজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য দূর করে, একটি সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সাহায্য করে।
মুসলমানদের দুটি ঈদ- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাও ধনী-গরিবের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একই আনন্দে আনন্দিত হওয়াতে সাহায্য করে। আর ঠিক একইভাবে ইসলাম বর্ণবৈষম্য রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ ইসলামে বর্ণবৈষম্যের কোনো স্থান নেই। আসলে সব মানুষ এক পিতার সন্তান। তাই ভাইয়ে ভাইয়ে কোনো বৈষম্য থাকতে পারে না। আর এ সম্পর্কে আল্লাহ-তায়ালা বলেন, 'হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন।' (সুরা নিসা, আয়াত: ১)। আর রসুল (স.) বিদায় হজের ভাষণে বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেছেন। বিদায় হজের সময় আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে নবি (স.) বক্তৃতা করেন। এ সময় তিনি বলেন, 'হে লোকজন, সাবধান! তোমাদের আল্লাহ একজন। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের ও কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের ও কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি ছাড়া। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু, সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান।
বলো, আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছি? সবাই বলল, হে আল্লাহর রসুল (স.), হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে যারা এখানে উপস্থিত আছে, তারা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ বাণী পৌঁছে দেয়। (বায়হাকি)। অন্য হাদিসে এসেছে, রসুল (স.) বলেছেন, 'আল্লাহ-তায়ালা তোমাদের চেহারা- সুরত, ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের কর্ম ও অন্তরের অবস্থা দেখেন (বুখারি : ৫১৪৪, ৬০৬৬)।'
একদিন এক সাহাবি অন্য এক সাহাবিকে তার মা কালো বর্ণের ছিলেন বলে তিরস্কার করেছেন। রসুল (স.) এতে ভীষণ রাগান্বিত হলেন। রসুল (স.) বললেন, 'তুমি এমন মানুষ, যার মধ্যে জাহেলি বর্বরতা রয়েছে।' (বুখারি ও মুসলিম)। অতএব, রসুল (স.)-এর ভাষ্যমতে, বর্ণবৈষম্য জাহেলিয়াত ও বর্বরতার অন্তর্ভুক্ত। যার ফলে আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। মহানবি হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারক। প্রাক- ইসলামী যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। গোত্রকলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল গোটা সমাজ। সামাজিক সাম্য-শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, নারীর মর্যাদা ইত্যাদির কোনো স্থায়িত্বই ছিল না। জঘন্য দাসত্ব প্রথা, সুদ, ঘুষ, জুয়া-মদ, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়-অত্যাচারের চরম তাণ্ডবতায় সমাজকাঠামো ধসে পড়েছিল, এমন এক দুর্যোগময় যুগে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব। তিনি আরবের বুকে বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে নবুওতের আলোকে উদ্ভাসিত করেন। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিকের বৈষম্য ঘুচিয়ে আনতে ইসলাম প্রবর্তন করেছে জামাতে নামাজ আদায়ের বিধান। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধভাবে একই কিবলামুখী হয়ে নামাজ আদায় করে সাম্যের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। এই সাম্য ও ঐক্যের জন্যই প্রবর্তন করা হয়েছে হজের বিধান, যেখানে সবাই একই পোশাকে হজ আদায় করে।
ইসলামের দর্শন হলো গোটা সৃষ্টিকুল একটি পরিবারের মতো। রসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, 'পুরো সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার সৃষ্টির প্রতি উত্তম আচরণ করে (শুয়াবুল
ঈমান: ৭০৪৮)।'
লেখক: ইসলামি গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএম ফাউন্ডেশন
আমার বার্তা/জেএইচ