ঢামেকে মাসে কোটি টাকার বিট বাণিজ্য

নেপথ্যে পিসি মিজানের তেলেসমাতি

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪, ১১:২০ | অনলাইন সংস্করণ

  আসাদুজ্জামান তপন

বিমানবন্দর আর পাসপোর্ট অফিসের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এখন আনসার সদস্যদের কাছে আরেকটি স্বর্গরাজ্য। কর্মস্থল হিসেবে এই জায়গাটি বেছে নিতে মরিয়া এখন প্রত্যেক আনসার সদস্য। ঢামেকে পোস্টিং পাওয়াটা তাদের কাছে সোনার খনির সন্ধান লাভের মতো। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করে খুব সহজে এখানে পার পাওয়া যায়, আর এতে আয় হয় প্রতিদিনই মোটা অংকের টাকা। ঢামেক সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই অপরাধ সাম্রাজ্যের নতুন রাজা হচ্ছেন ঢামেকে আনসারের পিসি বা প্লাটুন কমান্ডার মিজানুর রহমান। এই বাণিজ্য প্রবণতা আগে থেকেই চলছে। পিসি মিজান নতুন এসেছেন এবং তিনি আসার পর টাকার উৎস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।

শুধু মোটা অংকের টাকা দিয়ে এখানে পোস্টিং নিয়ে এলেই চলে না, এই রাজ্যের সদস্য হলে নিয়মিত টাকা দিতে হয় পিসি মিজানকে। তাদের দায়িত্ব বণ্টন নিয়েও চলে পিসি মিজানের বাণিজ্য। তাদের ভাষায় এটিকে বলে বিট বাণিজ্য। সুবিধামতো স্থানে দায়িত্ব পেতে মিজানকে দিতে হয় নজরানা। প্রাপ্য ছুটি পেতেও গুনতে হয় অর্থ। পিসি মিজানের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে হাসপাতালের ওষুধ চোরচক্র, দালাল ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। এদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরছেন পিসি মিজান। বছরজুড়ে এ আয়ের অংক পেরোয় কমপক্ষে দুই কোটি টাকা। এই ফান্ড থেকে পিসি মিজান এককভাবে পান প্রতি মাসে ৭০ লাখ টাকা। বাকি টাকা চলে যায় উপর মহল আর অন্য সদস্যদের পকেটে।

ঢামেক হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের দুজনের ভাষ্য, পিসি মিজানের নির্দেশে হাসপাতালের বিভিন্ন বিট থেকে মোটা অংকের অর্থ সংগ্রহ করেন কয়েকজন সহকারী প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি)। প্রতি সপ্তাহে জমানো টাকা তুলে দিতে হয় পিসি মিজানের হাতে। না দিলে ওই আনসার সদস্যকে বদলি করে দেয়া হয় বিটে।

অভিযোগ আছে, হাসপাতালের ২১১, ২১২, ২০৪ ও ১০৬ নং ওয়ার্ড, অপারেশন থিয়েটার (১০৪, ১০৫), প্যাথলজি, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ব্লাড ব্যাংক ও জরুরি ও বহির্বিভাগসহ বিভিন্ন স্থান (বিট) থেকে সাপ্তাহিক টাকা তোলা হয়।

ঢাকা মেডিকেলে বর্তমানে আনসার সদস্য ৩৫০। এর মধ্যে প্রতি মাসে পালাক্রমে মাসে প্রায় ৮০ জন ছুটিতে যান। ছুটিতে যেতে তাদের প্রত্যেককে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আনসার সদস্য আমার বার্তাকে জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন শিফটে ডিউটি করতে হয়। এ-শিফট অর্থাৎ সকাল, বি-শিফট অর্থাৎ বিকেল এবং সি-শিফট অর্থাৎ রাত। এই তিন শিফটে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ওয়ার্ডে ডিউটি দেন পিসি মিজান।

সেক্ষেত্রেএকেক শিফটের জন্য একেক পরিমাণের অর্থ পিসি মিজানকে দিতে হয়। কারণ দায়িত্ব বণ্টন করেন তিনি নিজে।
২১১ নম্বর ওয়ার্ড শিশু এনআইসিইউ ও নবজাতকদের (নিওনেটোলজি বিভাগ) জন্য বরাদ্দ। ২১২ নম্বর গাইনি ও প্রসূতি ওয়ার্ড। এ দুই ওয়ার্ডে ডিউটি নিতে হলে আনসার সদস্যদের প্রতি সপ্তাহে এ-শিফটে ৪০ হাজার টাকা, বি-শিফটে ৩২ হাজার টাকা এবং সি-শিফটে ৪৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এক্স-রে ইউনিটে দায়িত্ব নিতে সপ্তাহে এ-শিফটে সাত হাজার, বি-শিফটে সাত হাজার এবং সি-শিফটের জন্য তিন হাজার টাকা করে দিতে হয়। সিটি স্ক্যান ইউনিটে দায়িত্ব নিতে এ-শিফটে চার হাজার, বি-শিফটে চার হাজার এবং সি-শিফটের জন্য দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়।

২১১ নম্বর ওয়ার্ড শিশু এনআইসিইউ ও নবজাতকদের (নিওনেটোলজি বিভাগ) জন্য বরাদ্দ। ২১২ নম্বর গাইনি ও প্রসূতি বিদ্যা ওয়ার্ড। এ দুই ওয়ার্ডে ডিউটি নিতে হলে আনসার সদস্যদের প্রতি সপ্তাহে এ-শিফটে ৪০ হাজার টাকা, বি-শিফটে ৩২ হাজার টাকা এবং সি-শিফটে ৪৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়।

আলট্রাসনোগ্রাফি ইউনিটে ডিউটি পেতে এ-শিফটের জন্য প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় চার হাজার টাকা, বি-শিফটের জন্য দুই হাজার টাকা। ব্লাড ব্যাংক ইউনিটে দায়িত্ব পেতে সপ্তাহে এ-শিফটের জন্য চার হাজার, বি-শিফটের জন্য তিন হাজার এবং সি-শিফটের জন্য দুই হাজার টাকা দিতে হয়। প্যাথলজি বিভাগে দায়িত্ব পেতে এ-শিফটের জন্য প্রতি সপ্তাহে ছয় হাজার, বি-শিফটের জন্য চার হাজার এবং সি-শিফটের জন্য দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়।

১০৪-১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। এখানে দায়িত্ব পেতে এ-শিফটের জন্য দুই হাজার, বি-শিফটের জন্য দুই হাজার এবং সি-শিফটের জন্য এক হাজার টাকা দিতে হয়।

১০৬ নম্বর ওয়ার্ডে ডিউটি নিতে এ-শিফটের জন্য প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার এবং বি-শিফটের জন্য দুই হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে তিন শিফটের জন্য প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা। অবৈধ আয়ের আরেক খাত, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। হাসপাতালের নিয়ম, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সপ্তাহে দুদিন চিকিৎসকদের সাথে দেখা করতে আসতে পারবেন। কিন্তু প্রতি দিনই পাঁচ শতাধিক মেডিকেল প্রতিনিধি হাসপাতালে আসেন এই আনসারদের ম্যানেজ করে। বহির্বিভাগে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের একেক জনের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় হয় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা না দিলে বহির্বিভাগে ঢুকতে দেয়া হয় না তাদের।

কয়েকজন আনসার সদস্য আমার বার্তাকে জানান, কষ্টের পরিমাণ আমাদের বেশি। বিট থেকে টাকা তুলিও আমরা। অথচ আমাদের টাকা দেয়া হয় খুবই কম। বাইরে থেকে আয় করা টাকা পেসি নেনই, উল্টো আমাদের ছুটি পেতেও পিসির জন্য একেক জনকে গুনতে হয় দুই হাজার টাকা। পিসি মিজানের অধিনে ঢামেক হাসপাতালে প্রায় ৩৫০ জন আনসার সদস্য রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসে দুবার ২০ শতাংশ সদস্য ছুটিতে যান। অর্থাৎ ১৫ দিন পরপর ৮০ জন (কমবেশি হয়) আনসার সদস্য ছুটিতে থাকেন। এ ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে আরও ১০-১৫ জন ছুটি নেন। তারা মোট ১২ দিন ছুটি পান। কেউ এর চেয়ে বেশি দিন ছুটিতে গেলে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়।

ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল এখানে সক্রিয়। তাদের নির্বিঘ্নে কাজের সুযোগ দিতে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন পিসি মিজান। শুধু তা-ই নয়, দালালদের প্ররোচনায় ২১১ ও ২১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে রোগীদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন তিনি। এ দুই ওয়ার্ডে আয় বেশি, এ কারণে টাকার বিনিময়ে অসাধু আনসার সদস্যরা এখানে দায়িত্ব নেন।

পিসি মিজানের এসব অনিয়মের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঢামেকের এক কর্মকর্তা আমার বার্তাকে বলেন, এই আনসাররাই মূলত হাসপাতালের দালালচক্রকে লালন করেন। তাদের কারণেই দালাল উচ্ছেদ সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ওষুধ চোরচক্রই তাদের সাথে সমঝোরে চলে।

তারা আরও বলেন, আনসারদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে এ ধরনের অভিযোগ হাতেনাতে ধরা পড়ায় এক পিসিকে তিন বছরের জন্য সাসপেণ্ডও করা হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিসি মিজানুর রহমান বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি নতুন এসেছেন এখানে। এত টাকা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যেসব অনিয়মের কথা বলছেন তার কোনোটি সঠিক নয়। এগুলো সবই অপপ্রচার। একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব রটাচ্ছে।

আমার বার্তা/জেএইচ