গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী পদ বাগাতে মোসলেহ উদ্দিনের ২০ কোটি টাকার মিশন
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ২০:০৮ | অনলাইন সংস্করণ
বিশেষ প্রতিনিধি:
দেশের অন্যতম প্রধান প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে এক দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীকে নিয়োগের জন্য ২০ কোটি টাকার মিশনে নেমেছে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র। মিরপুর, আজিমপুর, মতিঝিলের ফ্ল্যাট প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া মোসলেহ উদ্দিনকে প্রধান প্রকৌশলী পদে বসাতে পূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান শুভ্রর এক জুনিয়ার আইনজীবীর সঙ্গে এই চুক্তি করেছেন গণপূর্তের দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী চক্র।
চুক্তি অনুযায়ী গত ২৪ অক্টোবর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয় ) পদ থেকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করা হয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যে তাকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার চুক্তি রয়েছে। আর এ কাজে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা জোনের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদের পরিচিতি ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’। অভিযোগ আছে, প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই হারে কমিশন নেন তিনি। জাতীয় সংসদ ভবনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোসলেহউদ্দিন। সেসময় নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি টাকা খরচ করে আলোচিত হন। তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে। সংসদীয় কমিটির তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবেও পরিচিতি আছে তার।
এই মোসলেহউদ্দিনকে ২০০০ সালের ১৩ জানুয়ারি তলবি নোটিশ পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়—‘সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদার জি কে শামীমসহ অন্য ব্যক্তিরা। এর মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ক্যাসিনো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ঘটনা ঘটেছে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য নেওয়া জরুরি।’
ওই বছর ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল মোসলেহউদ্দিনকে। সেই অনুযায়ী হাজির হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় গণপূর্ত অধিদফতরে ঠিকাদার-প্রকৌশলী সিন্ডিকেট, অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার ও বাড়ির মালিক হওয়া, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দেন দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন। এ বিষয়ে জানতে মোসলেহউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদক জানায়, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন এলাকা থেকে গ্রেফতার হন জি কে শামীম। ৩০ সেপ্টেম্বর জি কে শামীম ও তার সহযোগীদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ওই দিন থেকেই সংস্থার পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের অনুসন্ধান দল কাজ শুরু করে। ২১ অক্টোবর দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঠিকাদার জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম যাদের নাম বলেছে, তাদের মধ্যে প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিনের নাম আছে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র।
গণপূর্ত ও দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, ছাত্রজীবনে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি এজন্য নানা হয়রানিরও শিকার হয়েছিনে। তার আপন ভাই নাদিম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৫তম বিসিএস-এ যোগ দিয়ে পুলিশের এসপি হিসেবে ন্যাব-৮ ও এসবিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে তাদের উপর হামলা ও খুনের অভিযোগ রয়েছে।
বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিন ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদফতরে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ফেনী ও ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শেরেবাংলা নগর ও দীর্ঘ সময় প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে সমন্বয় বিভাগে ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগ্রাম জোনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সব জায়গাতেই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির পক্ষে সোহেল রানা ও গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষে গত ৫ ডিসেম্বর মো. বদরুদ্দীন ওমর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক প্রধান কার্যালয়ে পৃথক অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে তার ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থ-সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে মোসলেহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। যথেষ্ট নথিপত্রও পাওয়া গেছে। সরকারের বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে শিগগিরই সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলেও জানায় দুদক।
প্রসঙ্গত, যুবলীগের কথিত নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে সহযোগিতা, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে সহ ১১ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গত ১৮, ১৯ ও ২৩ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাদের। এছাড়া, গত ৫ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গণপূর্তের প্রকৌশলী ও ঠিকাদার সিন্ডিকেট নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন তিনি। গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলমের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে দুদক। আশরাফুল ও তার স্ত্রীর কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশও পাঠানো হয়েছে।
এসব অভিযোগের কারনে তাকে গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়। সরকারের পট পরিবর্তনের পর নিজেকে বঞ্চিত দেখিয়ে এ্যাবের কিছু প্রকৌশলী নেতাকে ম্যানেজ করে প্রধান প্রকৌশলী পদে বসার মিশনে নেমেছেন।
বিসিএস ১৫তম ব্যাচের গ্রেডেশন তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন মোসলেহ উদ্দিন। এক নম্বরে থাকা সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ময়মনসিংহ জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মইনুল ইসলামকে ডিঙ্গিয়ে এই পদ বাগাতে চাইছেন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। যা বর্তমান সরকারের নীতিবিরোধী একটি কাজ।
এ ব্যাপারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান শুভ্র বলেন, এগুলো সব অপপ্রচার। এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিভিন্ন মহল থেকে তদ্বির রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে, গণপূর্ত অধিদপ্তর অস্থিতিশীল হয় এমন কোনো কাজ করা হবে না।
প্রকৌশলী মোসলেউদ্দিনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
জাতীয় সংসদে অনিয়ম, দুর্নীতি তদন্তে গণপূর্ত বিভাগের তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু ওই সুপারিশ অনুযায়ী কোনও ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদফতর।
তিন দফা পদোন্নতি পাওয়ার পর মোসলেহউদ্দিনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করেন কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম। তিন কোটি টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহউদ্দিন।
গণপূর্ত অধিদফতরে কমিশনভোগী মোসলেহউদ্দিন ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত। ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি করেছেন তিনি। ঢাকা ও নোয়াখালীর চাটখিলের দৌলতখা গ্রামে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে তার। একইভাবে তাঁর স্ত্রীর নামেও বিপুল সম্পদ রয়েছে। টাকার জোরে এসব অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আমার বার্তা/এমই