শাহজালালে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আড়াল করে ‘মানবপাচার’ তকমার নেপথ্যের রহস্য উদ্‌ঘাটন

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিবেদক:

অবাক করা এক ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে আড়াল করে ‘মানবপাচার’ তকমা দেওয়ার অপকৌশল। আর এ ঘটনায় সিভিল এভিয়েশন নিয়ন্ত্রিত এভিয়েশন সিকিউরিটিকে (এভসেক) তোপ দাগার হীন অপপ্রয়াস নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। সপ্তাহ দু’য়েক আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনা নাগরিক মে পেনগাই’র সঙ্গে বাংলাদেশী নাগরিক মালিনা মারাক (১৯) এর চীন যাত্রাকে কেন্দ্র করে এমনই চাঞ্চল্যকর এক ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে। পরবর্তীতে পারিবারিক হস্তক্ষেপে বিষয়টির নিষ্পত্তি হলেও কথিত ‘মানবপাচার’ অভিযোগকে সামনে এনে মূলত পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। চটকদার ও ভুয়া তথ্যের এমন প্রবণতায় শাহজালের ভেতরে-বাইরে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশী নারী মালিনা মারাককে (১৯) বিয়ে করেন চীনা নাগরিক মে পেনগাই। পারিবারিকভাবে তাদের এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। কথামতো স্বামীর সঙ্গে মালিনার চীন যাত্রার কথা। যথারীতি গত ২৬ অক্টোবর তাঁরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। কিন্তু পরিবারের জন্য তরুণীর ব্যাকুল মন সায় দেয় না বিদেশ যাত্রায়। এতেই ঘটে বিপত্তি। শাহজালালের ডিপারচার এলাকায় ওই রাতে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যে কাঁদতে থাকেন মালিনা। দূর থেকে এই দৃশ্য হৃদয় স্পর্শ করে রাজধানীর উত্তরার একটি চাইনিজ কোম্পানির পরিচ্ছন্নতাকর্মী রানী আক্তারের। তিনি সেদিন বিমানবন্দরে এসেছিলেন তাঁর সেই কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের ‘সি অফ’ করতে। রানী এগিয়ে যান মালিনাকে স্বান্তনা দিতে। ঘটনাটি এমন হলেও তখনই সুযোগ-সন্ধানী একটি পক্ষ সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করেই খবর ছড়িয়ে দেয় বিয়ের প্রলোভন ও উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে মালিনাকে। ডিপারচার এলাকায় চায়না ইস্টার্ন ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টারের সামনে তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয় বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক)। তাঁরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। দু’চীনা নাগরিক মে পেনগাই (পাসপোর্ট নম্বর ঊগ৪৪৮৩৭০৯) ও তিয়ান জেংওয়েনকে (পাসপোর্ট নম্বর ঊঔ৪৩৭৪২৯৯) এবং বাংলাদেশি দুই তরুণী মালিনা মারাক (পাসপোর্ট নম্বর অ১৪৭৬৬৮৮৯) ও ২৬ বছর বয়সী রানী আক্তারকে (পাসপোর্ট নম্বর অ১৫২৭১৮৪৪) নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এভসেক এর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের কাছে সেদিনের ঘটনার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, এভসেক নিজেদের দায়িত্বের প্রতি পূর্ণ সচেতন থেকে প্রথমে বিমান বন্দরের বিজ্ঞ ম্যাজিষ্ট্রেট ও ইমিগ্রেশন পুলিশকে ওইদিনের পুরো বিষয়টি অবহিত করে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় এপিবিএন এভসেকের সদস্যদের সিআইডির মানবপাচার শাখায় যোগাযোগ করতে বলে। এভসেক’র খবরে সিআইডি উপস্থিত হয়ে মালিনা মারাকসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে একটি মামলা রুজু করার পরামর্শ প্রদান করে। কিন্তু মালিনা তাতে সম্মতি না দিয়ে পারিবারিকভাবেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে এভসেক দুই চীনা নাগরিক ও বাংলাদেশি দুই নারীকে এপিবিএন অফিসে রাখে। এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি (৩৩৮, তারিখ ২৬/১০/২০২৪) করা হয়। এরপর এপিবিএন তাদেরকে এভসেক’র হাতে তুলে দেয়। মালিনার অনুরোধে তাঁর বোনের স্বামী টিউপল সাংমাকে বিমানবন্দরে ডেকে আনা হয়। তাঁরা দু’জনই এভসেক’র কাছে লিখিত বক্তব্য দেয় এবং মালিনা ও মে পেনগাই’র বিয়ের কাবিননামা উপস্থাপন করে। বোনের স্বামী’র জিম্মায় মালিকানাকে তাঁর হাতে হস্তান্তর করা হলে সবাই সেদিন রাতেই আগমনী ক্যানোপি-২ দিয়ে টার্মিনাল বিমানবন্দরের বাইরে চলে যান। মালিনা ও তাঁর বোনের স্বামীর লিখিত বক্তব্যের কপি সংরক্ষণ করেছে এভসেক।

এভসেক’র ওই কর্মকর্তা বলেন, মালিনা ও রানী’র মধ্যে কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। কান্নারত মালিনার খোঁজ নিতে রানী আক্তার সেখানে আসেন। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যান। এখানে মানবপাচারের চেষ্টার অভিযোগটিও বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এর মাধ্যমে মূলত এভসেক’র উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিনষ্টের পায়তাঁরা চলছে। বিমানবন্দরের কোথাও নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। দুই চীনা নাগরিককে ছেড়ে দেওয়া বা নিরাপত্তার শঙ্কার বিষয়টি অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরও জানা যায়, গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিমানবন্দরে ব্যাপক নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি হয়। জনরোষের আশঙ্কায় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ (এপিবিএন) নিজেদের দায়িত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায়। কঠিন এক পরিস্থিতিতে ওইদিন ৬ ঘন্টা বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ বন্ধ থাকে শাহজালালে। পরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুরোধে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন শুরু করে। বিমান বাহিনী ও এভসেক’র সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের সবচেয়ে বৃহৎ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভেতরে-বাইরে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। যাত্রী লাঞ্ছনা, লাগেজ চুরি থেকে শুরু করে চোরাচালানসহ সব রকমের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এতে বদলে যেতে শুরু করে শাহজালালের চেনা দৃশ্যপট। বদলে যাওয়া এই বিমানবন্দরটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেশ-বিদেশের সবাই। কিন্তু গাত্রদাহ শুরু হয় একটি পক্ষের মাঝে। যারা দীর্ঘদিন শাহজালালকে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন রীতিমতো তাদের মাথায় হাত পড়ে। ফলে শাহজালালের নিরাপত্তায় এভসেক ব্যর্থ, তাঁরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, এমন সব উস্কানিমূলক তথ্য ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সত্যসন্ধান ও সত্য প্রচারে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটু সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলছেন চলমান এই পরিবর্তনের পক্ষের মানুষজন।

যদিও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চলমান তাক লাগানো পরিবর্তনকে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল হিসেবেই দেখছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুইঁয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব বিমানবন্দরই এভিয়েশন সিকিউরিটির আওতায়। এটিই নিয়ম। হযতর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। আমরা এভসেক’র সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছি। বর্তমানে এভসেকের প্রায় দেড় হাজার সদস্য রয়েছে। আমরা এটিকে সাড়ে তিন হাজারে উন্নীত করতে চাই। এটি সম্ভব হলে এয়ারসাইট ও আউটার সাইট সবদিকেই এভসেকের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। বর্তমানে কোথাও কারও দায়িত্ব পালনে কোন সমস্যা হচ্ছে না। যার যেখানে থাকা প্রয়োজন সেখানেই প্রত্যেকে কাজ করে যাচ্ছেন। দৃশ্যমান এই পরিবর্তনকে টেকসই করতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই।’