মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষিজমি, সরকারি খাসজমি, জলাধারের পার্শবর্তী এলাকা এমনকি সড়ক-মহাসড়কের আশেপাশের স্থান থেকে মাটি কেটে অবৈধভাবে বিক্রি করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। রাতের আঁধারে ড্রাম-ট্রাকের মাধ্যমে এই মাটি পাচার করা হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটা ও নির্মানাধীন এলাকায়। এতে একদিকে যেমন কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যার ফলে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে গোচারণ ভূমি, পুকুর জলাশয়, বীজতলা ও কৃষি জমি।

জেলার বিভিন্ন স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, কৃষি জমির মাটি সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফসলি জমির মাটি বিক্রি ও ভরাটের হিড়িক পড়েছে। অথচ আইনে উল্লেখ আছে নিজের জমি থেকেও কেউ মাটি কেটে বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

ভুমি সংক্রান্ত আইনে বলা হয়, "ফসলি জমির মাটি কাটলে জেল হতে পারে। ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন-২০২৩ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ফসলি জমির টপ সয়েল (জমির উপরের অংশ) কাটলে দুই বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে"।

সরেজমিন পরিদর্শনে আরো দেখা যায়, মাটিবাহী গাড়ির চাপে নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন সড়ক। বিশেষ করে ঢাকা-সিঙ্গাইর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। মধ্যরাতে খোলাভাবে মাটি আনা-নেয়াকালে রাস্তায় পড়ে থাকা কাঁদামাটিতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন। বিশেষ করে বৃষ্টির পর কর্দমাক্ত সড়কগুলোতে বেশি ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

কয়েকটি মাটিবাহী ট্রাক থামিয়ে বিভিন্ন এলাকার মাটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য কারা তা জানতে চাইলে মাটিবাহী গাড়ি চালকরা নিজ প্রাণ ভয়ে চক্রের সদস্যদের নাম প্রকাশ না করলেও বলেন, "মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা, দৌলতপুর উপজেলা ও সদর উপজেলার বেতিলা-সিঙ্গাইর আঞ্চলিক সড়কের আশেপাশের বেশ কিছু স্থান থেকে নিয়মিত মাটি কাটছে বেশ কিছু চক্র। ভয়ভীতি দেখিয়ে কৃষি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে তারা।"

মাটি পাচারে বাধা দিলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের বিষয়টিও এসময় উঠে এসেছে।

মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, "রাত ১০টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত খোলা অবস্থায় মাটি ও বালিবাহী ট্রাক বেপরোয়া গতিতে মানিকগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী কালিগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে বেউথা এলাকা থেকে বাসস্ট্যান্ড হয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করছে। এতে সড়কজুড়ে বালি ও মাটির স্তপ জমে গেছে। ফলে ধুলোবালিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শহরবাসীকে।"

বেউথা এলাকার ভ্যান চালক হারেস খাঁ বলেন, "দিনে ক্ষ্যাতে কাম করি, প্রত্যেকদিন সকালে ভ্যান নিয়া বাইর হই। বাজারের সবজি আর হোটেলের মালামালগুলাই বেশি টানি। কিন্ত রাস্তায় বেশি মাটি-বালির ট্রাক চলাচল করায় সব সময় আতঙ্কে থাকি। তারা যে গতিতে গাড়ি চালায় এতে যেকোন সময় এক্সিডেন্ট ঘটতে পারে। আর রাস্তায় তো ধুলাবালি জমেই। মাঝেমধ্যে চোখেও যায়।"

মানিকগঞ্জ বিজয় মেলা মাঠ মোড় ও খালপাড় এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, মাটি ও বালির ট্রাকের ধুলোবালির কারনে দোকানে খোলা খাবারের ব্যাবসা করা অত্যন্ত কষ্টকর।

শিবালয় উপজেলার কৃষক নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, "কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রান। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের কৃষি জমি থেকে মাটি চুরি ও দখল করা হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে অতিশীঘ্রই কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস হবে এবং দেশের খাদ্য শশ্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়বে। প্রশাসনের উচিৎ দ্রুততম সময়ের মাঝে মাটিখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।"

রাতের বেলা খোলা অবস্থায় বালি ও মাটি বহনের বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশের টহল দলের উপ-পরিদর্শক মীর শহিদুল বলেন, "ট্রাক চালক ও মাটি-বালি ব্যবসায়ীদের বারবার সতর্ক করার পরও তারা সেটা গ্রাহ্য করছে না। মাঝে মাঝেই ট্রাক জব্দ করে জরিমানা করা হয়। এরপরও তাদের থামানো যাচ্ছেনা।"

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "বিষয়টি জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে উত্থাপন করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হলে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করবো।"

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা আমার বার্তাকে বলেন, "মানিকগঞ্জ জেলায় টপ-সয়েল কেটে বিক্রি করার অপরাধে অনেকগুলো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হয়েছে এবং জেল-জরিমানা করা হয়েছে। যারা মাটি কাটে এবং ইট ভাটায় বিক্রি করে এদেরকে আমরা বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। এরপরেও কিছু অপরাধ জারি আছে! কারন আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা, কৌশলগত সীমাবদ্ধতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা আছে। এজন্য সবক্ষেত্রে আমরা এটা বন্ধ করতে পারিনি। আমরা যেখানেই খবর পাই সেখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি।"