গত ১৫ দিন ধরে বরিশাল নগর থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট। তেল না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষজন। অনেকে বাধ্য খোলা সয়াবিন তেল কিনছেন।
এমন সংকটের জন্য বোতলজাত সয়াবিন তেলের ডিলার এবং কোম্পানিকে দোষারোপ করছেন দোকানি ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, তেলের সঙ্গে একই কোম্পানির চাল-ডাল, সুজি, হলুদ ও মসলা না নিলে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাদের যেসব পণ্যের চাহিদা বাজারে নেই, সেসব পণ্য না রাখলে তেল দিচ্ছেন না। এমনকি সয়াবিন তেল বিক্রিতে কোনো ধরনের মুনাফা দিতেও রাজি নন তারা। এজন্য দোকানে তেল রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সর্বশেষ সোমবার (২৫ নভেম্বর) নগরের বাংলা বাজার এবং বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা দোকানগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। যারাই তেল কিনতে আসছেন, দোকানিরা বলছেন নেই। ছয়-সাতটি দোকান ঘুরেও তেল পাননি অনেকে। তাদের প্রশ্ন, তেলের কি সংকট চলছে?
অনেকে নগরের বড় দোকানে তেল না পেয়ে পাড়া-মহল্লার দোকানে যান। একই অবস্থা দেখে দোকানির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান ক্রেতারা। এমন এক ক্রেতাকে উদ্দেশ্য করে তখন দোকানি বলেছেন, কোম্পানিগুলোর বেঁধে দেওয়া শর্তে রাজি না হওয়ায় তেল দিচ্ছে না। এজন্য দোকানে তেল নেই।
তেল না পেয়ে ভোগান্তি
তেল না পেয়ে ভোগান্তির কথা জানিয়ে নগরের কালুশাহ সড়কের বাসিন্দা মো. তুহিন আহমেদ বলেন, ‘অন্তত ছয়টি দোকান ঘুরেছি। কোনও দোকানে তেল নেই। সবাই বলছেন, নেই-নেই। এটা তো আমাদের জন্য ভোগান্তি। দোকানিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ কারও দোকানেই তেল নেই।’
শুধু নগরে নয়, উপজেলা পর্যায়ের দোকানগুলোতে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে অনেক ক্রেতা মনে করছেন, সংকট। তবে বাস্তবে কোম্পানির বেঁধে দেওয়া শর্তের কারণে তেল রাখছেন না দোকানিরা।
উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের উপজেলার খুচরা ও পাইকারি দোকানগুলোতে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। সংকট মনে করে আমরা খোলা তেল কিনছি। পরে শুনেছি, সংকট নেই। কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা শর্ত মেনে তেল বিক্রি করছেন। ওই শর্তে তেল কিনলে খুচরা বিক্রেতাদের লাভ হয় না। এজন্য তারা কোনও কোম্পানির তেল দোকানে রাখছেন না।’
নগরের সিকদারপাড়ার একটি বাসার কেয়ারটেকার ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমার বাড়িওয়ালা সয়াবিন তেল কেনার জন্য দোকানে পাঠান। সিকদারপাড়া এবং খান সড়ক এলাকার ১০টি দোকান ঘুরেও পাইনি। তেল নেই কেন জানতে চাইলে কোনও দোকানি কিছু বলেননি। এরপর বাংলা বাজারে গিয়েও পাইনি। সেখানে গিয়ে দেখি, ড্রামজাত তেল কেজি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। পরে সেই তেল কিনে এনেছি।’
চাল-ডাল-মসলা না কিনলে মিলছে না সয়াবিন তেল
দোকানে তেল নেই কেন জানতে চাইলে বাংলা বাজারের খুচরা দোকানি মো. ধলু মিয়া বলেন, ‘তেল রাখতে চাইলে সঙ্গে তাদের কোম্পানির পোলাওয়ের চাল, মিনিকেট চাল ও ডাল রাখার শর্ত দিচ্ছেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা। আবার যত টাকার তেল রাখবো, তত পরিমাণ টাকার চাহিদাহীন পণ্য রাখা বাধ্যতামূলক বলে দিচ্ছেন তারা। এরপর তেলের বোতলের গায়ে যে দাম লেখা, সেই দামে বিক্রি করতে হবে। তাও মানতে রাজি ছিলাম। কিন্তু যেসব পণ্যের ক্রেতা নেই, সেসব পণ্য রাখলে আমাদের তো লোকসান হবে। লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা উল্টো তেল রেখে বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে। এর চেয়ে বরং ওই টাকার অন্য পণ্য দোকানে রাখলে কিছুটা হলেও লাভ হবে। এজন্য তেল রাখছি না।’
একই কথা বলেছেন এই বাজারের খুচরা দোকানি গিয়াস উদ্দিন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এক কোম্পানির তেল রাখতে চাইলে সঙ্গে তাদের জিরা এবং ধনিয়া গুঁড়াসহ মসলা আইটেম নেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্য কোম্পানির এক কার্টন সয়াবিন তেল রাখতে হলে এক তাদের কার্টন সরিষার তেলসহ বিভিন্ন পণ্য রাখা বাধ্যতামূলক। আরেক কোম্পানি তাদের পোলাওয়ের চাল-ডাল এবং মিনিকেট চাল রাখার শর্ত দিচ্ছে। এই কারণে বোতলজাত সয়াবিন তেল দোকানে তোলা বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।’
বোতলের গায়ে লেখা দামে তেল বিক্রি করতে আমরা রাজি উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘কারণ মাসিক যারা ক্রেতা আছেন, তাদের সব মালামাল দিতে হয়। তা না হলে প্রতিযোগিতার বাজারে অন্য দোকানে চলে গেলে ক্রেতা হারাতে হয়। ফলে তেল বিক্রিতে লাভ না থাকলেও আমরা রাখতাম। কিন্তু এখন যেসব শর্ত দিচ্ছে কোম্পানিগুলো, তা কোনোভাবেই মানা সম্ভব না হওয়ায় তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছি।’
কেন এমন শর্ত
কেন এমন শর্ত দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে একটি কোম্পানির বরিশালের ডিলার বলেন, ‘কোম্পানির এ ধরনের পলিসির বিষয়ে আমার জানা নেই। কোম্পানি থেকে বিক্রয় প্রতিনিধি দেওয়া হয়। তারা দোকানে গিয়ে পণ্যের চালান কাটেন। তাদের অর্ডারমতো গুদাম থেকে তেল দোকানে পাঠাই আমরা। কাজেই বিক্রয় প্রতিনিধিদের এ ধরনের শর্তের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই।’
এ ব্যাপারে জানতে পাঁচটি সয়াবিন তেল কোম্পানির বরিশালের বিক্রয় প্রতিনিধি এবং এরিয়া ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, এটাই কোম্পানির পলিসি। তাদের যেভাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, সেভাবে শর্ত বেঁধে দিয়ে পণ্য বিক্রি করছেন তারা।
সমাধান কী
এই সংকটের সমাধান কী জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কোম্পানিগুলো এরকম শর্ত দিয়ে তেল বিক্রি করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুই-একদিনের মধ্যে আমরা বাজার মনিটরিং শুরু করবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারী বলেন, ‘এ নিয়ে কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। যেহেতু এখন বিষয়টি জানলাম, মঙ্গলবার থেকে অভিযান চালানো হবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন