সংস্কার কমিশনগুলোর কর্মকাণ্ডে নির্বাচনের সময় পিছিয়ে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, কমিশন সংবিধান পুনর্লিখন করবে না, বরং সংবিধান সংস্কারে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে কিছু সুপারিশ করবে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের কমিশনকে দুটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম দায়িত্ব বিদ্যমান সংবিধানকে পর্যালোচনা করা এবং দ্বিতীয় দায়িত্ব সংবিধান সংস্কারে কিছু সুপারিশ করা। আমরা সংবিধান পর্যালোচনার কাজটি শেষ করেছি। সুপারিশগুলো আমরা তৈরি করছি না। আমরা সবার মত নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করে প্রধান প্রধান বিষয় শনাক্ত করে আমরা একত্রিত করছি।
কমিশনে যারা আছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা, শিক্ষকতা করছেন। আমাদের কমিশনে শিক্ষক আছেন, আছেন আইনজীবী, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও ছাত্র প্রতিনিধি। আমাদের মতামত আছে, তবে অংশীজনদের মতামত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজার মানুষ মতামত দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের মাধ্যমে আমরা ৩৫ হাজার বাসা-বাড়ি থেকে মতামত গ্রহণ করেছি। সব মত নিয়েই কমিশন সুপারিশ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের বিষয়টি আমাদের কমিশনের অংশ নয়। এ জন্য আলাদা কমিশন রয়েছে, সেটা তারা দেখবে। সংবিধানে যতটুকু সংশ্লিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আমরা কথা বলব। নির্বাচনের বিষয়টি সরকারের প্রশ্ন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা হচ্ছে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সেই আলোচনা আরো দৃঢ় হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আরো বলেন, দেশ তো রাজনীতিবিদরাই চালাবেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসেননি, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছেন। ১৬ বছর ধরে এ দেশে একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র ছিল। শেষদিকে এসে গত জুলাইয়ে যা হয়েছে— গণহত্যা, নৃশংসতা, শব্দগুলো সেই ভয়াবহতাকে ধারণ করতে পারে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার দেশের মানুষের ওপর এই আচরণ করেছে, কারণ দেশের ব্যবস্থাটা সে রকম ছিল। ফলে দেশে গণতন্ত্র দরকার, তার জন্য নির্বাচন দরকার। তবে নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। আমি যেটা মনে করি, নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। নির্বাচনের জায়গায় যাওয়ার পথ খুঁজতে হবে। মানুষের মাঝে একটি আকাঙ্ক্ষা আছে, মানুষ পরিবর্তন দেখতে চায়।
সংস্কার কমিশনের কর্মকাণ্ডে নির্বাচন পিছিয়ে যাচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, না, পিছিয়ে যাচ্ছে না। দেখুন, কমিশনগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৯০ দিনের জন্য। সেই সময় কি পার হয়েছে? পার তো হয়নি। ফলে কেউ যদি বলে আপনারা এত সময় নিচ্ছেন কেন— যে নির্বাচনব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, এর জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া যাবে না? কোনো আস্থা নেই এই নির্বাচনব্যবস্থার ওপর এবং তার কারণও রয়েছে। ২০১১ সাল থেকে সংবিধান সংশোধন করার নামে নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। ফলে এসব সংস্কার করতে আপনাকে এই সময়টুকু তো দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারি, রাজনৈতিক দলগুলো চায় দ্রুত নির্বাচন হোক। কিন্তু তার জন্য তো নির্বাচনব্যবস্থাকে একটু ঠিক করতে হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। একটি নির্বাচন কমিশন হয়েছে, তাদের দায়িত্ব ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। সেটাও তো বেশি সময় হয়নি। তাদের একটু সময় দিন।
সংবিধান ‘পুনর্লিখন’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ভুল বোঝাবুঝি নেই। ’৭২ থেকে ’৮৩ সালের সংবিধান দেখে আমার মনে হয়েছে, দেশে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র হওয়ার একটি আশঙ্কা রয়েছে। সেটা আমার বইতে আমি উল্লেখ করেছিলাম। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমার সেই আশঙ্কাটা থাকল। সেটাও আমার আরেকটি বইতে উল্লেখ করেছি। এই বিবেচনা থেকে একাডেমি অর্থে আমার কাছে মনে হয়েছে, শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্রের একটি ভিত্তি কিন্তু এই সংবিধান। তাহলে এই সংবিধান এভাবে রেখে আপনি আগাতে পারবেন? সেই বিবেচনা থেকে আমি বলেছি, সংবিধান পুনর্লিখন দরকার। যার অর্থ হচ্ছে, মর্মবস্তুর দিক থেকে এটাকে এমন করবেন যেন ওই পথে (একনায়কতন্ত্রে) আর না যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে, আপনি পুনরায় না লিখে এখানে যেতে পারবেন না।
তিনি বলেন, আমি পুনর্লিখনের কথা বলেছি গত আগস্টে। তখনো কিন্তু আমি জানি না আমাকে এই সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হবে। আর কমিশনে আমি কিন্তু একা নই, ৯ জন। দেখুন কমিশনের দায়িত্ব কিন্তু সংবিধান লেখা নয়। আমরা সংবিধান লিখছি না। আমাদের দায়িত্ব অংশীজনরা কী বলছে, তা বিবেচনায় নিয়ে কিছু সুপারিশ দেবো।
আলী রীয়াজ আরো বলেন, সংবিধান সংস্কারে আমরা কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি যেটার ওপর ভিত্তি করে আমরা সুপারিশগুলো দেবো। এই লক্ষ্যগুলো হলো— যেন ফ্যাসিবাদ ফেরত না আসতে পারে, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ না হয়, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে, স্থানীয় সরকারগুলো শক্তিশালী হয়, মানুষের অংশগ্রহণের পথ তৈরি হয়। এই সুপারিশমালা যখন বাস্তবায়ন করা হবে, যারা করবেন, তারা এগুলো সংবিধানের মধ্যে নেবেন। আমরা এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করছি না, তবে যারা করবেন তারা যেখানে অল্প সংস্কার প্রয়োজন করবেন, কোথাও আপনাকে কিছু লিখতেই হবে নতুন করে। আমি একটি উদাহরণ দেই, ধরুন বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চায়। বাংলাদেশের এখনকার সংবিধানে কি এটা আছে? নেই, তাহলে আপনাকে লিখতে হবে।
অংশীজনরা সংবিধানকে সহজ ভাষায় লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, এখন কেউ যদি বলে, সংবিধানকে সহজ ভাষায় লিখুন, সেটা তো পুনর্লিখনই। বাংলাদেশের সংবিধান চলিত ভাষার পরিবর্তে সাধু ভাষায় লেখা কেন প্রশ্ন করে তিনি আরো বলেন, আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেই ভাষায় আমরা সংবিধান লিখতে পারব না কেন? সেটা পারার কথা। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় আমি আবারও বলি, এই সংস্কার আমরা করছি না। যারা করছেন তাদের প্রতি মানুষ এই সংস্কারের কথা বলছে।
সংবিধান মানুষের অধিকার রক্ষার হাতিয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু আমি যেই জিনিস বুঝি, সেটা আমার অধিকার রক্ষা করবে কিভাবে? আমি পড়ে যখন বুঝব, আমাকে এই অধিকারটা দেওয়ার কথা, এখানে অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাহলে আমি সংবিধান দেখিয়ে বলতে পারব, দেখুন আমার এই অধিকার ছিল আপনি লঙ্ঘন করেছেন।
সংবিধান পুনর্লিখন প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার কমিশন সুপারিশগুলো দিয়ে বলবে, এই এই স্থানে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারে কোন কোন অনুচ্ছেদে প্রভাব ফেলবে সেটাও বলে দেবে।
সংস্কার কমিশনের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, প্রত্যেকটা কমিশন কাজ করছে একটা নির্ধারিত সময়। কারো কারো ক্ষেত্রে কয়েক দিন বেশি লাগতেই পারে। মানুষের কথা শুনে, সেটার বাস্তবতা বিবেচনা করে, সেটাকে সুপারিশমালায় পরিণত করতে হবে। এতে ৫-১০ দিন সময় অতিরিক্ত লাগতে পারে। এখন পর্যন্ত কেউ কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের কথা বলছেন না।
৩১ তারিখে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার যে কর্মসূচি নিয়েছে ছাত্ররা, বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর দেওয়া হবে’— এতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, এখন পর্যন্ত ওনারা যা বলেছেন তার সবটুকু আমি জানি না। তাদের বক্তব্য শুনেছি গণমাধ্যমে যতটুকু এসেছে, দেখি ৩১ তারিখ কী বলেন। তারা ঘোষণাপত্রের কথা বলেছেন, দেখি তাদের ঘোষণাপত্রে কী থাকে। আমাদের দায়িত্ব ভবিষ্যতের সংবিধানে কী কী থাকবে তার সুপারিশ করা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের অনুরোধে অংশীজন হিসেবে তারা এসেছিলেন। তাদের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন তারা যে কথাগুলো বলবেন, সেগুলো আমরা অবশ্যই বিবেচনায় নেবো। রাজনীতিতে যা ঘটছে, বিশেষ করে সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি যদি বক্তব্য থাকে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। কোনো কিছু নির্ধারক হবে কি না সেটা তার গভীরতার ওপর নির্ভর করবে। সে জন্য আমি আগাম কিছু বলছি না। দেখি তারা কী বলে।
গত ১৫ বছরে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আর্থিক খাতে লুটপাট এগুলোর ক্ষেত্রে সংবিধান তাকে (শেখ হাসিনাকে) রক্ষা করেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, করেছে। কারণ হচ্ছে, সংবিধানের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বীজ ছিল। এ সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে এই ক্ষমতা দেয় যে, তিনি একাধারে চারটি পদ অলঙ্কৃত করতে পারেন; দলের প্রধান হতে পারেন, সংসদ নেতা হতে পারেন, তার দলের প্রধান হন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। পাওয়ার করাপ্টস; অ্যাবসুলেট পাওয়ার করাপ্ট অ্যাবসুলেটলি, এটাই প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান এই পথটা বন্ধ করেনি। বাংলাদেশের সংবিধানে আপনি প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে পারবেন না।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, লুটপাটে শুধু সংসদ সদস্যদের দায়ী করবেন না। একটা লুটপাটতন্ত্র ক্লিপ্টোক্রেসি তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে এদেশে লুট হয়েছে। এবং এতে এক পরিবার যুক্ত ছিল বহু পরিবারের সঙ্গে। এবং একটা অলিগার্কিক (গোষ্ঠীশাসন) সিস্টেম, কয়েকজন মানুষের একটি গোষ্ঠী তৈরি করে লুট করা হয়েছে। ব্যাংকের টাকা লুট করা হয়েছে, উন্নয়নের নামে টাকা লুট করা হয়েছে। এটা হচ্ছে ক্লিপ্টোক্রেসি, সহজ বাংলায় চোরদের রাজত্ব। রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে চুরি হয়েছে। সেখানে আমলা জড়িত, ব্যবসায়ী জড়িত, রাজনীতিবিদ জড়িত, ক্ষমতায় যারা আছেন সেই পরিবার জড়িত। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ব্যবহার করে বা নাম দিয়ে কিংবা নামের কারণে অনেক প্রকল্প পাশ করা হয়েছে। সেই টাকার কোনো হিসাব নেই।
আমার বার্তা/এমই