বাংলাদেশের উন্নয়নের বহুমুখী খাতগুলো তারুণ্যের পদচারণে মুখর হয়ে উঠবে, এটাই সবার কাম্য। কিন্তু দেশে এখন তরুণসমাজের খুবই দুঃসময় চলছে। তাদের মধ্যে দিকনির্দশনার ঘাটতি ও হতাশা বিরাজ করছে। গুণগত শিক্ষায় পশ্চাদপদতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণামূলক শিক্ষার অভাব, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচণ্ড দুর্বলতা, অপুষ্টি, চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব—এসব সমস্যা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনার দ্বারকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এ ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপরাজনীতির শিকার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, মাদকাসক্তি প্রভৃতি কারণে বহু তরুণ আজ বিপথগামী এবং পথভ্রষ্ট।
সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের তরুণসমাজকে নোংরা রাজনীতি, সন্ত্রাস, নেশা ও কালোটাকার ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে। তাদের হাতে মাদক ও অস্ত্রের বদলে জ্ঞানের মশাল তুলে দিতে হবে। তাদের সঠিক দিকনির্দশনা প্রদান আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
প্রতিদিন সকালে স্কুলে যে জাতীয় সংগীত গাই, সেখানে প্রমিজ করি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সোনার বাংলাকে কীভাবে ভালেবাসি, সেটা কি ভেবে দেখেছি? তারপর ভালোবাসা ধরা, ছোঁয়া বা দেখা যায় না, শুধু হৃদয় অনুভব করে তার অনুভূতি। অনুভবগুলো মূলত আসে আমাদের কর্মের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। যাই হোক সোনার বাংলা গড়তে কোনো ধরনের নেতৃত্ব চায় নতুন প্রজন্ম, এ বিষয়টি আমি ভেবেছি, যার ফলস্বরূপ বিবেকের কাছে আমি প্রশ্ন করতে চাই। যেভাবে চলছে, দেশ তাতে কি মনে হয় রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের ইনক্লুসিভ সংসদ সদস্যদের নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে?
নতুন প্রজন্ম মা–বাবা থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রশিক্ষণ এবং সমাজের কাছে পারিবারিক মূল্যবোধ শিখতে পারছে কি? সততা, নিষ্ঠা, সত্যবাদিতা, স্পষ্টবাদিতা, দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, পাংচুয়ালিটি, কমিটমেন্ট, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি নতুন প্রজন্ম শিখতে চায় কি?
দেশপ্রেমী প্রজন্মের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হলে নতুন প্রজন্মকে মেধা, মননশীলতা, দেশপ্রেম ও মানবতার প্রেরণায় মনোবল নিয়ে অভিভাবকদের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে, সেটা কি সঠিকভাবে করা হচ্ছে?
অনেকে বলবে অতীতের দিনগুলো ছিল মুখর এবং নানা রঙে ভরা। সেই মুখর রঙের সুর বাজে আমার প্রাণে আজও। তবে ভেঙে গেছে সেই মধুর মিলনমেলা, ভেঙেছে সেই হাসি আর রঙের খেলা। কারণ, কোথায়, কখন, কবে, কোনো তরুণ ঝরে যাচ্ছে, সমাজে সে খবর কেউ রাখছে না! মনে হচ্ছে সবকিছুর পরিবর্তন দ্রুতগতিতে চলছে। চোখের পলকে পাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। গতকাল যা আমার কাছে নতুন বা প্রয়োজনীয় ছিল, আজ তা না হলেও চলে যাচ্ছে। কী জানি আগামীকাল কী হবে!
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে এ ধরনের সমস্যা আসবেই। আমরা নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে অতি দ্রুত মানিয়ে নিতে চাই। অনেক কিছু মিস করে ফেলব এই ভয়ে দ্রুত সবকিছু পেতে চেষ্টা। এর কারণে আমাদের নানা ধরনের সমস্যারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ এক ভিন্ন সময়, এ এক করোনা মহামারি এবং বিশ্বযুদ্ধের সময়। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সমস্যা আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর একটির চেয়ে অন্যটি ভয়ংকর। এই করোনা ফ্যাশনের হাত থেকে আমরা কেউই কিন্তু পালিয়ে থাকতে পারছি না। কারণ হলো আমাদের হাতে ফোন, ঘরে স্যাটেলাইট টেলিভিশন, তাছাড়া ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন এতটাই সহজসাধ্য হয়ে পড়েছে যে কোনো কিছু থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। সব খবর মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হচ্ছে সত্য-মিথ্যার যাচাই-বাছাই ছাড়া। আমাদের সবারই এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে অজান্তে। তারপর কোথায় কী পণ্যদ্রব্য ফ্যাশন বের হচ্ছে নিত্য-নতুন, এসব দামি উপকরণ সংগ্রহ করা সবার পক্ষে সম্ভব না হলেও আমাদের নজর পড়ছে সেখানে। যাদের অঢেল টাকা আছে, কেবল তারাই এগুলো ব্যবহার করতে পারছে, বাকিরা বসে বসে স্বপ্নের রাজ্যে ডুবে মরছে।
একজন গরিব মানুষের সন্তানেরও এসব উপকরণ ব্যবহার করার শখ হয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতদরিদ্র পরিবার এগুলো সন্তানদের কিনে দিতে পারছে না ফলে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই অশান্তি সীমা অতিক্রম করে ফেলছে।
সবাইকে নিয়ে নয় আজ আলোচনা করব তরুণ সমাজকে নিয়ে। অন্যান্য সবার মতো নতুন প্রজন্ম সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্টতার দিকে এগিয়ে চলছে, হতাশার চোরাবালিতে নিমজ্জিত হয়ে তারা শেষ করে দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব। পুরো বিশ্বের নতুন প্রজন্মদের দেখে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে সর্বত্র একটা শূন্যতা, হাহাকার বিরাজ করছে। সবকিছু থাকতেও তারা সন্তুষ্ট নয়; তারা খুঁজছে কিন্তু জানে না কী? যার যত বেশি আছে সে আরও পেতে উঠে পড়ে লেগেছে। এ সমস্যা আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা সদ্যই বয়ঃসন্ধিকাল পার করে এসেছে, তাদের জন্য প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। কী কারণ জড়িত, এই ক্রমাগত অধঃপতনের পেছনে তা আমরা যদি একটু খেয়াল করে দেখি, তাহলে এর সত্যতা সহজেই খুঁজে বের করতে পারব। এত কিছুর পরও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কঠিন এবং জটিল সমস্যা জড়িত রয়েছে। তার কারণ মুখস্থবিদ্যার সঙ্গে পরীক্ষার পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে সৃজনশীল শিক্ষার্থী তৈরির জন্য তোড়জোড় চলছে, আর অন্যদিকে পরীক্ষা নামক এক অদ্ভুত বোঝা তরুণদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে সমস্যার এই চক্র থেকে তারা কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছে না।
কী অবস্থা তরুণ প্রজন্মের এবং কী-ইবা তাদের প্রত্যাশা
কী অবস্থা তরুণ প্রজন্মের এবং কী-ইবা তাদের প্রত্যাশা
এ সমস্যা প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। এখন যদি শিক্ষার্থী কোনো একটাতে সামান্যতম খারাপ করে, তাহলে পরিবার থেকে নেমে আসে সীমাহীন লাঞ্ছনা। তারপর তুলনা করা অন্যান্যদের সঙ্গে যার ফলে মানসিক অশান্তি অল্প বয়সে জীবনকে গ্রাস করতে শুরু করছে। বলতে গেলে বাস্তবতার নির্মম পরিহাস অলস জীবনের চাওয়া-পাওয়া সীমারেখা মস্তিষ্কের ভেতরটাকে বড় নোংরা করে দিয়েছে। কেউ বুঝতে চেষ্টা করছে না যে প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব সক্ষমতা আছে। তাকে বাইরে থেকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং এই চাপের ফলে ডিম যেমন বাইরের চাপে ভেঙে যায় তেমনটি ভেঙে যাচ্ছে তরুণদের জীবনের পরিকাঠামো!
ডিম যেমন তার নিজের ভেতরের চাপে সৃষ্টি করে নতুন জীবন তেমনটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত বর্তমান প্রজন্ম, তাই যে চেতনায় তাদের আলোর মতো বা ফুলের মতো ফুটে উঠার কথা তা না হয়ে বাইরের চাপের কারণে অঙ্কুরে বিনাশ হয়ে ঝরে পড়ছে সমাজের লাখো লাখো তরুণ। পরীক্ষায় কিংবা জীবনের যেকোনো পর্যায়ে ভালো করার যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাতে করে অনেকেই অসাধু উপায়ে ভালো ফল পেতে চেষ্টা করছে। কারণ, এই নতুন প্রজন্ম বাইরের চাপ না পারছে গ্রহণ করতে, না পারছে সহ্য করতে। এর আসল কারণ কী? সবকিছু না চাইতে পাওয়া বা সহজে পাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। এ যুগে কাউকেই কিন্তু কিছু পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। জন্মের পর থেকেই তো সবকিছু তাদের হাতের নাগালে! একটি দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে যদিও এমনটি সচরাচর হচ্ছে না।
দেশে লাখো প্রজন্ম প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে যা দেশের ক্ষমতাসীন দল এবং সরকার জানে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তেমন বিশেষ কিছু এদের জন্য করছেও না। হতাশাগ্রস্ত এই তরুণদের একটা বড় অংশ বর্তমানে মোবাইলের মধ্যে পর্ন, গেমসের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়েছে। এটা মাদক আসক্তির চেয়েও ভয়াবহ হতে চলছে দিনের পর দিন। এদের চিন্তায় বিরাট এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই রোগে তরুণ, বৃদ্ধ সকলেই আক্রান্ত। কোনো কিছু তলিয়ে দেখার অবকাশ কারো নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ এদের জীবনের একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে। জোর করেও একে কাঁধ থেকে নামাতে পারা সম্ভব না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ঘটনা যখন সামনে আসছে, তখন অতি দ্রুত দুটো পক্ষ তৈরি হচ্ছে এবং নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এরা পরস্পরকে তীর্যকভাবে আক্রমণ করছে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি আমি যে বিষয়টি বেশি লক্ষ করছি এবং কষ্ট পেয়েছি সেটা হলো, কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুতে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্টের বন্যা। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম পুরোপুরি সোচ্চার। যেন এটা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজই নেই! একজন মানুষের মৃত্যুতে কেন খুশি হতে হবে, বিষয়টা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমাদের মতের দ্বিমত হতেই পারে তাই বলে তার মৃত্যুর সময়ে আমি খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠব! এই সংকটের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী কে, তা নিয়ে ভাবা উচিত।
পিতা-মাতার দায়িত্ব হবে তার সন্তানকে বুকে আগলে রাখা। তা না হলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে চোখের সামনে। শুধু চেয়ে দেখবে সবাই কিছুই বলার বা করার থাকবে না শেষে। যে প্রজন্মের বুকে অসুস্থ চাওয়া-পাওয়া আর হাহাকার এসে বাসা বেঁধেছে তাদেরকে হৃদয়ের মাঝে ফিরিয়ে এনে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব এখন সবার।
সুস্থ এবং সৃজনশীল সমাজ পেতে বর্জন করতে হবে দুর্নীতি আর অর্জন করতে হবে সঠিক এবং সুশিক্ষা। ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার।’ তরুণদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। বাঙালি জাতি স্বাধীন হলেও এবং দেশের অনেক উন্নতি হলেও এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছে না। মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানেরা এর সুফল ভোগ করছে, যা স্বাধীনতার চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার ছিল স্বাধীনতার চেতনা। এ চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে আমাদের সমাজ। প্রভাবশালীদের অনৈতিক কার্যকলাপ আমাদের স্বাধীনতাকে কালিমাযুক্ত করছে। তরুণরা কখনো এটা প্রত্যাশা করে না।
তাদের প্রত্যাশা হলো, দেশে স্বাধীনতার মৌলিক চেতনা ফিরে আসুক। সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদায় সিক্ত হোক আমাদের সমাজ। প্রত্যেকের মধ্যে জাগ্রত হোক মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ। স্বাধীন দেশ হয়ে উঠুক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রত্যেক নাগরিক হয়ে উঠুক মানবিক মানুষ সেই সঙ্গে তারা ভুলে যাক সব রাজনৈতিক দল। তারা গড়ে তুলুক দেশ গড়ার দল, যে দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হবে, যে খেলার মধ্যে থাকবে কে কত ভালো পারফরমেন্স করছে তার দেশের পরিকাঠামো এবং অবকাঠামোকে শক্ত ও পরিপক্ব করতে।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
আমার বার্তা/জেএইচ