বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ ও দেশপ্রেমিক জনতার রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরু করেছে। এ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো পচে যাওয়া রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধান সংশোধন করে সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসনের সূচনা করা; যাতে ভবিষ্যতে কোনো সরকার স্বৈরাচারী হতে না পারে। ভোটের অধিকার ও সরকারের দায়িত্বশীলতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের সামনে কাজ অনেক। দীর্ঘদিনের অপশাসনে প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নাগরিক হয়রানি ও দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব কাজ একত্রে এ সরকারের পক্ষে স্বল্প লোকবল নিয়ে দ্রুত করা সম্ভব নয়। আবার খুব বেশি সময় নেওয়াও অনভিপ্রেত। কারণ, বেশি সময় নিলে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার গণতান্ত্রিক দাবি তুলে রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দাবি ওঠাবে। এ জন্য সরকারকে কাজের অগ্রাধিকার বিবেচনা করতে হবে। স্বল্প সময়ে করা সম্ভব এমন কিছু কাজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে।পুরো বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের শেষ পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের বাজেট পুনর্বিবেচনা করে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। এ খাতে নেয়া প্রকল্পগুলোর যথার্থতা যাচাই করা উচিত। তথ্য ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়নে যেখানে পুরো বিশ্ব তার তরুণদের উন্নয়নে সর্বোচ্চ ব্যয় করছে, সেখানে কোনো ভাবেই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দে সংকীর্ণতার সুযোগ নেই। দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদের উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে তাদের মধ্যে নানা পার্থক্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। যেমন, আমেরিকার পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও চীন সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কথা বলা যায়, কিন্তু একটি জায়গায় তারা এবং যেকোনো উন্নত দেশ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী-মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে তা তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা তাদের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে। শিক্ষা ও গবেষণার প্রভাব ও ব্যাপকতা অত্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষের আধিক্য। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) তথ্য অনুসারে, দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশই তরুণ। এ তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজি বাস্তবায়নে শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বারবার পাঠ্যক্রম পরিবর্তন এবং এ খাতে বিনিয়োগ অপ্রতুল থাকায় আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে পড়ছি। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও যুগোপযোগী সংস্কার প্রয়োজন। দুই হাজার চব্বিশ-পঁচিশ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় চৌরান্নব্বই হাজার সাতশো দশ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের এগারো দশমিক অষ্টাশি শতাংশ এবং জিডিপির এক দশমিক উনসত্তর শতাংশ।
দুই হাজার তেইশ-চব্বিশ অর্থবছরে ছিল জিডিপির এক দশমিক ছিয়াত্তর শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত বিশ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাজেটের বারো শতাংশের ওপর উঠছে না। এমনকি জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, একশো উননব্বই-টি সদস্য দেশের মধ্যে যে দশটি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির বিপরীতে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ভুটান। দেশটিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ মোট জিডিপির আট দশমিক এক শতাংশ। এছাড়া এ বরাদ্দের হার ভারত ও মালদ্বীপে চার দশমিক ছয় শতাংশ এবং আফগানিস্তানে চার দশমিক তিন শতাংশ।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো না হলে সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি,সংস্কৃতি,বিজ্ঞান- প্রযুক্তি, নীতি-নৈতিকতা, আইন, সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে, যা জাতিকে চরম মাত্রায় ভোগাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। তাই শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে এ খাতের বিনিয়োগে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ অতীব জরুরি।এছাড়া গুণগত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষানীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং সঠিক পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের ভূমিকায় রাষ্ট্রকে তৎপর হতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মান সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-দুই হাজার চব্বিশ অনুসারে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় সাতাত্তর দশমিক নয় শতাংশ।যা উনিশ-শো একাত্তর সালে ছিল ষোল দশমিক আট শতাংশ। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে।
এ তথ্য থেকে বুঝা যায় যে, শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্য ভাবে হয়েছে। কিন্তু মানের প্রশ্নে তেমন কোনো নজির নেই বললেই চলে। কারণ শিক্ষায় বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম দেয়া হয়েছে, শুধু তা-ই নয়। যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেটাও যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে অপব্যয় করার অভিযোগ আছে। দেশের
শিক্ষা ও প্রযুক্তির বরাদ্দ একসঙ্গে দেয়া হয়। শিক্ষার জন্য বরাদ্দ আলাদাভাবে দেয়া উচিত। শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার মান উন্নয়নে উদ্যোগ কম দেখা যায়। শিক্ষা খাতের উন্নয়ন করতে হলে এসব বিষয়ে পরিবর্তন আবশ্যক। সুতরাং দেশে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে বরাদ্দ। শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক প্রণোদনা, সুপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক ও উন্নত কারিকুলাম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও গবেষণায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মানচিত্রে জায়গা করে নিতে প্রয়োজন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও গবেষণাকর্মের অগ্রগতি। বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়ানো এক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয়।নয়তো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে হিমশিম খেতে হবে দেশকে। প্রযুক্তিনির্ভর না হলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্লথগতি দেখা দেবে। অন্যদিকে মানুষ কর্মচ্যুত হবে। প্রথাগত কাজে মানুষের প্রয়োজন ফুরাবে। কর্মচ্যুত মানুষকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া সম্ভব কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে। কেননা উৎপাদনের সব উপকরণই নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে। সে অনুযায়ী জনগণকে দক্ষ করতে পারলে দেশে বেকারত্ব চড়াও হবে না, বরং মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা ও মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষকদের সংগঠন থাকলেও তাদের ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরে না। লাশ পড়ে না। গেস্টরুম, গণরুম, ফাউ খাওয়া, টর্চার সেল গড়ে ওঠে না।সেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য নেই।শিক্ষার্থীরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেন না। এসব না করেও তারা যদি মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট হতে পারেন, তাহলে আমরা কেন একাডেমিক পরিবেশ নষ্ট করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নেতা তৈরির কারখানা বানাতে অনুমোদন দেব? ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি না করায় ইউরোপ-আমেরিকার পার্লামেন্টে কি কখনো মানসম্পন্ন নেতার অভাব হয়েছে? আর আমাদের দেশে কি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ‘ছাত্র ব্যবসা’ করে মানসম্পন্ন নেতা তৈরি হচ্ছে? বিরাজমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা এখানে রাজনীতি করছেন আর্থিক মুনাফা অর্জন ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার অভিপ্রায়ে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বিরাজিত এ আত্মবিধ্বংসী রাজনীতি বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাগ্রে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, দলীয় সরকারগুলো এ ক্ষেত্রে সবসময় দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। তারা মুখে বলে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিজড়িত হওয়া কাম্য নয়। তাদের উচিত লেখাপড়া, গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করা। কিন্তু কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন অধ্যাপককে ডেপুটেশনে নিয়োগ দিতে হলে তারা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে যাচাই করে ক্ষমতাসীন দলীয় মনোভাবাপন্ন না হলে কিছুতেই নিয়োগ দেন না। সরকারের এ দ্বিমুখী ভূমিকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি চর্চার প্রবণতা বাড়ে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের সাংঘর্ষিক রাজনীতি বন্ধ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সরকারি প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, সব সরকারি কর্মকর্তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। শিক্ষাঙ্গনে নিয়মশৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা কর্মজীবনেও তার চর্চা করবেন।সুতরাং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে শিক্ষাক্রমে যুগোপযোগী সংস্কার আনা এ সময়ের দাবি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ