স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়ন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর থেকেই রেমিট্যান্সের পালে হাওয়া লেগেছে। প্রতি মাসেই দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে গড়ে প্রতিদিন দেশে প্রায় ৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে মোট রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২৩৯ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় এসেছে গত মাসে এবং এতে ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রবাসী পাঠানো রেমিট্যান্স গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অক্টোবরে ২১.৩১ শতাংশ বেড়েছে। তবে সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরের প্রবাহ কমেছে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ। গত জুলাই মাস ছাড়া এপ্রিল থেকে প্রবাসীরা ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে জুনে, যার পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ডলার। একক মাস হিসেবে গত তিন বছরের মধ্যে এটি ছিল দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রবাসী আয় আসার রেকর্ড। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে এসেছিল ২৫৯ কোটি ডলার।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রবাসীরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে, তা দেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেক। প্রবাসীদের কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ একটি সম্মানজনক অবস্থানে দাড়িয়েছিল। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস হল রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। মূলত প্রবাসী যোদ্ধাদের মাধ্যমে অর্জিত আয়ই রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সকে বলা হয় দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি এবং উন্নয়নের ভিত্তি, স্বপ্নের সোনালী সোপান ও অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির ১২ শতাংশ এবং বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় সরকার বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা অধিক রেমিট্যান্স আহরণের জন্য দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রবাসীদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ রেমিট্যান্সের টাকায় তৈরি হয়েছে ছোট ছোট উদ্যোক্তা এবং শক্তিশালী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২৪০ কোটি ডলার। গত আগস্টে আয় এসেছিল ২২২ কোটি ডলার। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে গত সরকারের সময়ে ভারতের আদানি গ্রুপ, কাফকোসহ, শেভরন ও বিপিসিকে সরবরাহকারী বেশকিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের ওপরে বকেয়া ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই মাসে আন্তব্যাংক থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেনা পরিশোধ করেছে এবং এখনও ৭০০ মিলিয়ন ডলার দেনা বকেয়া আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিজার্ভে হাত না দিয়ে অচিরেই এই দেনাও পরিশোধ করা হবে। অর্থপাচার ঠেকানোর পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে আন্তব্যাংকে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন ডলারের চেয়ে টাকার দাম বেশি। যে কারণে ডলারের প্রতি মানুষের এখন আগ্রহ কম। টাকার প্রতি আগ্রহ বেশি। ডলারের তুলনায় টাকাতে এখন বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। এছাড়া অনিশ্চয়তা কাটতে শুরু করেছে তেল, গ্যাস, সারসহ দরকারি পণ্য আমদানিতে।ডিসেম্বরের মধ্যে সব দায় মেটানোর পর, আরও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে অর্থনীতি।
প্রবাসীদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মেটায় না, তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে, অবকাঠামো উন্নয়ন, সঞ্চয়ে উদ্ভূদ্ধকরণ এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে। জাতীয় অর্থনীতির তাই অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্য সরকারের আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্য বেড়েছে। রেমিট্যান্স একই সঙ্গে দেশের বেকার সমস্যা ও কর্মসংস্থান নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া জনশক্তি রফতানির ফলে বিরাট সংখ্যক জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা ও খাদ্যসামগ্রীও স্থানীয়ভাবে জোগাড় করতে হচ্ছে না। সারা বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি, যারা সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন।
আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা রফতানি নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত। শুধু নিশ্চিত বিনিয়োগ নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবেও জনসংখ্যা রফতানিকে বিবেচনা করা যায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানির যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পারিশ্রমিক যাতে কাজ ও দক্ষতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সেজন্যেও সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে, জনসংখ্যা রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যদি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে, তাহলে জনসংখ্যা রফতানির সুফল ও রেমিট্যান্স প্রবাহ আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক খাতের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হবে।
অবৈধ হুন্ডি প্রতিরোধের কারণে বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ বহুলাংশে বেড়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা অবৈধ পথ এড়িয়ে বৈধপথেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন। বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে, শুধু বাড়েনি, নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট ব্যাংকিং, শাখা উপশাখার কারণে রেমিট্যান্স পাঠানো খুব সহজলভ্য হয়েছে। রেমিট্যান্স আয় আরো বৃদ্ধি করার জন্য হুন্ডি প্রতিরোধে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখি পদক্ষেপ নিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।
বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জনশক্তি রফতানি খাত ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক মহীরুহু। কিন্তু এ খাতের সম্ভাবনাকে এখনো পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অনেকেই জমি ফ্লাট ক্রয়ের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছে। অর্থ উপার্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি সমান তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে সেই অর্থের উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানায় ব্যবহার এবং তা নিশ্চিত করা। পরিকল্পিতভাবে জনশক্তি রফতানি খাতের সমস্যা সমাধান এবং পেশাজীবী ও দক্ষ জনশক্তি বিদেশে প্রেরণের পাশাপাশি তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা গেলে এ খাত দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী যাওয়ার ফলে শুধু প্রবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু শ্রম অনুযায়ী রেমিট্যান্স বাড়ছে না। দেখা গেছে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন প্রবাসী কর্মীরা ভালো বেতনের চাকরিতে নিয়োগ পান এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অধিকতর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অদক্ষ কর্মীরা যে পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করে তা দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম। আন্তর্জাতিক মানদন্ডেও বাংলাদেশের কর্মীদের মান অনেক নিচে। দেখা গেছে অদক্ষ প্রবাসীরা অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হয় এবং তারা কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করলেও বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না। এ কারণে তারা রেমিট্যান্স প্রেরণে হুন্ডিকেই বেছে নয়।
জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করায় প্রবাসীরা অর্থ পাঠাতে না পারায় ওই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। তবে জুলাই–আগস্ট মাসের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মধ্যে বৈধ পথে প্রবাসী আয় না পাঠানোর যে প্রচারণা ছিল, তাতে পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রচারণায় সাড়া দিয়ে অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা অর্থনীতিতে স্বস্তির জায়গা তৈরি করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করবে।
শেখ হাসিনা সরকারের করা বিপুল ঋণ পরিশোধের চাপ যখন বাড়ছে তখন রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকছেন প্রবাসীরা। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। প্রবাসীরা অক্টোবর মাসে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা জুলাই মাসে রেমিট্যান্স বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আগের চেয়ে বেশি গতি বেড়েছে প্রবাস আয়ে। এতে শক্তিশালী হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তার পরের মাসগুলোতে অব্যাহতভাবে বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ।
একজন প্রবাসী কর্মী তাঁর পরিবার বা দেশে থাকা অন্যান্য ব্যক্তির কাছে প্রবাস থেকে যে অর্থ স্থানান্তর করেন তাই প্রবাস আয় বলে বিবেচিত হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাস আয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত। একদিকে যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের আয় সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে, অন্যদিকে তাদের পাঠানো অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/জেএইচ