ঢাকার ভাসানটেক সরকারি কলেজের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.ইরম জাহান দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সম্প্রতি। ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বগ্রহণকারী অধ্যাপক ড.ইরম জাহানের সাথে অনেকদিনের পরিচয়রে সুবাদে এই সুশিক্ষককে নিয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি, ভাব-অনুভবও। আমার দীর্ঘদিনের চেনা-জানা পরিচয়ের বলয়ের,আমাদের পরিবারের সুখ-দু:খের সময়ের পরম স্বজন, বিশেষত: দু:সময়ে সবার আগে যাকে কাছে পেয়েছি তিনিই আমাদের প্রিয়মুখ ইরম আপা,অধ্যাপক ড. ইরম জাহান। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি জীবনচর্চায় তিনি যেমন একজন সৎ মানুষ,তেমনি জীবনাদর্শেও সত্যিকারের ভালো মানুষ। তাঁর কাছ থেকে সততার শিক্ষা গ্রহণ করা যায় বলেই আমার গভীর প্রতীতি জন্মেছে। এটা মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়।
আমার ব্যক্তিগত এবং আমাদের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর পক্ষ থেকে ভাসানটেক সরকারি কলেজের নবাগত অধ্যক্ষ মহোদয়কে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
‘মঙ্গল আসর’-এর প্রায় শুরুর সময় থেকেই নিরন্তর প্রেরণা,উৎসাহ জাগানো-জোগানো মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে পেয়ে যেমন আবেগ আপ্লুত,তেমনি অসম্ভব আনন্দিতও। তবে এই আনন্দক্ষণে তাঁর এবং আমার, আমাদের খুবই আপনজন,প্রিয় মানুষ- সদা হাস্যমুখ মিতু আপার কথা খুব মনে পড়ছে। ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনকালে দীর্ঘ রোগ-ভোগে প্রয়াত অধ্যাপক সানজিদা আখতার,আমাদের মিতু আপা কী খুশিই না হতেন আজকের দিনে,বিশেষত অধ্যক্ষ পদে আপনজন লাবণ্য’র যোগদানকালে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের সাথে সহযাত্রী হতেন, যিনি যে কোন পরিবেশকে সরস ও আনন্দমুখর করে তুলতে ছিলেন অতুলনীয়। মহান করুণাময়ের কাছে প্রিয় মিতু আপার আত্মার শান্তি কামনা করি।
ইরম আপার পরিবারের সাথে গভীর মেলামেশার সুযোগে বলতে পারি সন্তান-স্ত্রী-মা হিসেবে তিনি যেমন অসম্ভব দায়িত্বশীল ভূমিকায় সক্রিয় ছিলেন,আছেন তেমনি প্রিয় শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের প্রতিও তাঁর দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করে। ব্যক্তি জীবনেও তিনি সহজ-সরল,অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য দৃশ্যমান হয়নি আমার কাছে।
একজন বইপ্রেমি দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি হিসেবে তাঁর বাসার পারিবারিক সমৃদ্ধ পাঠাগারটির উল্লেখ করতেই হয়। যেখানে সুনির্বাচিত বইয়ের সমাহারই জানান দেয় তাঁর পাঠাভ্যাস প্রীতিকে, বইয়ের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসাকে। বইয়ের প্রতি এই আলোকিত উত্তরাধিকার বহন করতে দেখি তাঁদের একমাত্র সন্তান মেধাবি শিক্ষার্থী ইনানের জীবনেও। তাঁর স্বামী আমিন ভাইয়ের মতোন মৃদুভাষী সজ্জ্বন,সারল্যময় ভালো মানুষের দেখা আমি আমার এই জীবনে খুব কমই পেয়েছি।
জীবনের দীর্ঘ সময় দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী সরকারী কলেজ ঢাকা কলেজসহ শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর মূল্যবান সময় এবং শ্রম দিয়েছেন, দিয়েছেন স্নেহ-ভালোবাসা। হয়ে উঠেছেন অনেকের জীবনেই পথপ্রদর্শক। শিক্ষকদের তো এমনটিই হওয়ার কথা। ঢাকা কলেজে নানাবিধ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের কথা ভেবেই লিখেছেন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একাধিক বই। শিক্ষার্থীদের মাঝে বইয়ের ব্যাপক চাহিদার ধারাবাহিকতাই সুলেখক হিসেবে মানসম্পন্নতার ইতিবাচকতাকে প্রতিফলিত করে।
প্রায় দুই দশকের শিক্ষকতা এবং ‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনায় গভীরভাবে অনুধাবন করেছি সমাজ গঠনে আর সুশিক্ষার জন্য চাই সুশিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে ভালো পাঠদান করলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। এর বাইরেও একজন শিক্ষকের অনেক গুণ থাকা প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীদের যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন শিক্ষকের সমকক্ষ অন্য কেউ হতে পারেন না। আদর্শবান শিক্ষকরাই পারেন একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের এই বিপুল জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে শিক্ষকগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রভাব শিক্ষকের। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অনুসরণ করে। একজন শিক্ষার্থীর সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে পারেন একজন শিক্ষক। এমন আদর্শবান শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছি তাঁর মাঝে,তাঁর সংস্পর্শ পেয়ে। আমার জীবনে আদর্শবান মহান শিক্ষকদের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
নৈতিকতা ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ শিক্ষকই সুশিক্ষক। শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণ ও তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত নির্মাণ এবং সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষক অনুঘটক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই শিক্ষকতা কোনো পেশার নাম নয়, বরং এটা নেশা। শিক্ষাবিদ হিসেবে ইরম আপার শিক্ষাচিন্তার সাথেও আমি অপরিচি নই মোটেই। আমরা দু’জনই শিক্ষক বলে আমাদের অসংখ্য দিন, অজস্র সময় কেটেছে শিক্ষা-শিক্ষকতা সংক্রান্ত আলোচনা-বিতর্কে। আমরা সবসময় একমত হতে পারিনি বটে কিন্তু মতান্তর হলেও মনান্তর ঘটেনি কখনো,আমাদের সম্পর্কের সেতুবন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে মননশীল শিক্ষা ও জীবন চিন্তাচর্চায়।
‘মনের দারিদ্র্যতা দূর করতে না পারলে অর্থনৈতিক দারিদ্র্যতা দূর করা অসম্ভব।’ ভাবনায় আমাদের সহমত প্রকাশ পায় যেমন, তেমনই আবার আমাদের দু’জনেরই প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ভাবনাকে গভীর আস্থায় নিয়ে উচ্চারণ করতে পারি,‘অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করতে না পারলে দেশের শ্রীবৃদ্ধি বেগমান করা অসম্ভব’। আর এখানেই ইরম আপার মতোন সুশিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অপরিহার্য বিবেচনা করি।
এই অভাজনের একান্ত ভাব-অনুভবকে,পর্যবেক্ষণজনিত আবেগ-উচ্ছ্বাসকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাই। সবশেষে আবারো অধ্যক্ষ মহোদয়কে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। আলোর পথযাত্রীর স্বপ্নযাত্রার সহযাত্রী সকল প্রাণকে উজ্জীবিত করুন আলোয় ভুবন ভরিয়ে দিতে। প্রত্যাশা করি তাঁর সুস্থ-সুন্দর-আনন্দময় দীর্ঘায়ু। সকলের মাঝে শুভবোধের জাগরণ হোক, মঙ্গল হোক।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/আবদুল্লাহ আল মোহন/এমই