ই-পেপার মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

অনিয়ন্ত্রিত ঋণ ও খেলাপি সংস্কৃতি : ব্যাংকিং খাতের আত্মহননের ছক

প্রজ্ঞা দাস:
০৫ মে ২০২৫, ১২:৪৪

ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বলা হয় অর্থনীতির হৃদযন্ত্র। এই হৃদযন্ত্র যদি রক্ত পাম্প না করে, রাষ্ট্র নামের দেহব্যবস্থা অকেজো হয়ে পরবে। কিন্তু বাংলাদেশে এই হৃদযন্ত্রে পচন ধরেছে।হিসাবের খাতা বলছে আমরা ঋণ দিয়েছি, বাস্তবতা বলছে টাকা আর ফেরত আসবে না। আর খেলাপিদের শ্বেতশুভ্র করপোরেট মুখাবয়ব যেন রাষ্ট্রের নরম হাতের আশ্রয়ে আরও শক্তিশালী হচ্ছে । ব্যাংকের দেয়ালে ‘আস্থা’, ‘নিরাপত্তা’, ‘সেবা’ এই শব্দগুলো ধ্বনিত হয় ঠিকই কিন্তু বাস্তবে তা যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাসে পরিণত হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়মিত রেগুলেটরি কাঠামো এবং দুঃসাহসী দুর্বৃত্তায়ন সব মিলিয়ে যেন ধসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। এটা শুধুই অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা নয়, এটা রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার এক গোপন দেউলিয়াত্ব। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১,৭৮,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংক থেকে যে টাকা সাধারণ জনগণের আমানতের ভাণ্ডার থেকে ধার দেওয়া হয়েছিল, তার একটি বিশাল অংশই আর ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। এটা কেবল সংখ্যা নয় বরং অর্থনীতির রক্তক্ষরণের পরিমাণ।

ঋণখেলাপের বেড়াজালে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ধারণাটিই আজ বিকৃত হয়েছে। এখান ঋণ হলো একশ্রেণির জন্য মূলধনের প্রবেশপথ, অন্যশ্রেণীর জন্য দেউলিয়াত্বের পূর্বাভাস। কর্পোরেট খেলাপিদের দীর্ঘ তালিকায় নাম আছে নামি-দামি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, প্রভাবশালী শিল্পপতি ও রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের। তারা কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা বিনিয়োগ তো করেইনি বরং বিভিন্ন চ্যানেলে পাচার করেছেন, অথবা লোক দেখানো প্রকল্পের নামে সেই টাকায় আত্মীয়-পরিজনের নাম নথিভুক্ত করে রেখেছেন। যা ক্রমাগতই ক্ষমতার অপব্যবহারের নামান্তর হয়ে উঠেছে।ব্যাংকিং খাতের এই সংকটের মূলে রয়েছে সুশাসনের শূন্যতা। মূলত ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং জবাবদিহিতার ঘাটতি এই সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। ব্যাংকগুলো প্রায়শই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করে। ফলে অযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ঋণ পায়। এই ঋণগুলোর বেশিরভাগই পরে খেলাপি হয়ে যায়। কারণ এগুলো প্রদান করা হয় অপ্রতুল জামানত এবং দুর্বল ব্যবসায়িক পরিকল্পনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত দশকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণের প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে কোনো প্রকৃত ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হয়নি। এই অবিবেচনা কেবল ব্যাংকের সম্পদ নষ্ট করেনি, বরং অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর অক্ষমতা এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। বাংলাদেশে আইনি প্রক্রিয়া এতটাই দীর্ঘসূত্রী যে, একটি খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি হতে গড়ে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে ঋণখেলাপিরা তাদের সম্পদ স্থানান্তর করে ফেলে। ফলে ব্যাংকের ব্যবস্থা নেওয়ার কিছুই থাকে না। এই পরিস্থিতি একটি বিষাক্ত সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে ক্ষমতাশালীদের ঋণ পরিশোধ না করাটাই একটি সামাজিক আচরণে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংকিং খাতের এই অরাজকতা কঠোর হস্তে দমন করা। কিন্তু বাস্তবে ঋণ খেলাপিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় নিরব অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।

এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে মাত্র ১২টি উল্লেখযোগ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, যেখানে প্রতি বছর গড়ে ৫০টিরও বেশি অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার দুর্বলতাকে প্রকাশ করছে। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলকরণ নীতি খেলাপি ঋণের সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। এই নীতিতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসেবে দেখায়, যা তাদের আর্থিক দুর্বলতাকে আড়াল করছে । ফলে সমস্যার মূল কারণ সমাধানের পরিবর্তে এটি কেবল স্থগিত হয়ে ফাইল বন্ধ থাকছে।এই সংকটের ছায়া অর্থনীতির সর্বত্র ছড়িয়ে পরেছে। ব্যাংকগুলোর মূলধন ক্ষয়ের কারণে ঋণ প্রদান ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা শিল্প ও বাণিজ্যে বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছে। আরও গভীর ক্ষত হচ্ছে জনগণের আস্থায়। একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৪০% আমানতকারী ব্যাংকে তাদের আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই আস্থার সংকট ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটকে তীব্র করছে, যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার সম্ভাব্য মুনাফা হারিয়েছে। এই অর্থ যদি অর্থনীতিতে পুনঃবিনিয়োগ করা যেত, তাহলে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারত। এই ক্ষতি কেবল ব্যাংকের নয়; এটি পুরো দেশের ক্ষতি। তবে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব যদি আমরা এখনই সাহসী ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে পারি। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ঋণ বিতরণে ঝুঁকি বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে হবে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়া সহজ করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। ঋণখেলাপিদের নাম প্রকাশ করতে হবে, যাতে সামাজিক চাপ তাদের ঋণ পরিশোধে বাধ্য করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ক্ষমতা জোরদার করাও জরুরি। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাও এই সংকট সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যাংকগুলোকে তাদের সেবার মান বাড়াতে হবে, গ্রাহকদের জন্য স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থা চালু করতে হবে, এবং আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকিং খাত আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে।বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আজ একটি অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। অনিয়ন্ত্রিত ঋণ এবং খেলাপি সংস্কৃতি এই খাতকে এমন এক পথে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন। এটি কেবল একটি সিস্টেমের ব্যর্থতা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের নিরব আত্মসমর্পণ। তাই এই সংকটকে এখনই ঠেকাতে হবে।সঠিক সংস্কার, দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সমাজের সব স্তরের সচেতনতার মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।একটি পুনর্গঠিত ব্যাংক খাত শুধু অর্থনীতিকেই পুনরুজ্জীবিত করবে না, বরং হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ যেকোনো সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পেছনে থাকে একটি দৃঢ় ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাংকিং ভিত্তি।এটাই হতে পারে আমাদের আগামী অর্থনৈতিক মুক্তির ভিত্তি।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।

আমার বার্তা/জেএইচ

নৈতিক সাহসের অভাবেই রাষ্ট্রব্যর্থতা, নিজেকে বদলানোই জাতির মুক্তি

আমি কখন ভালো হবো?—এই প্রশ্নটি যতটা ব্যক্তিগত মনে হয়, বাস্তবে তা একটি জাতির আত্মার আর্তনাদ।

রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক করিডোর

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশীরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে এবং পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রন

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের হুমকি : আঞ্চলিক নিরাপত্তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন। এই শাসন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা-তারেককে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা দেশ থেকে বংশসহ নির্বাসিত

ডিবির অভিযানে ঢাকায় বাগেরহাটের সাবেক এমপি মিলনসহ গ্রেপ্তার ৯

১৭ বছর পর দেশের মাটিতে জোবাইদা রহমান

দেশে ফিরলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগে হিরো আলমের বিরুদ্ধে মামলা

চুলের বৃদ্ধির জন্য সেরা ৫ প্রাকৃতিক তেল বানাবেন যেভাবে

ফিরোজার সামনে নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড়

ঢাকার বাতাস আজ সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, স্কোর ১২৬

শাপলা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হাসিনা, বাস্তবায়নে বেনজীর

খালেদা জিয়ার ফিরে আসা গণতন্ত্র উত্তরণকে সহজ করবে: ফখরুল

বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার, কাজ করছে সেনাবাহিনীও

মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রমূলক নানা অভিযোগের ব্যাখ্যা দিল আটাব

যে পথে বিমানবন্দর থেকে ফিরোজায় ফিরবেন খালেদা জিয়া

ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, সার্বিক বিষয় বাংলাদেশকে জানাল পাকিস্তান

ইউটিউব দেখে মোটরসাইকেল চুরি শিখে প্রথম দিনই ধরা

কক্সবাজারে নতুন আসা এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৫৪ ফিলিস্তিনি

গ্যাস সংকটে দেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত

হজযাত্রীদের সতর্ক করে সৌদি আরবের নির্দেশনা

মস্কোতে ভয়াবহ ড্রোন হামলা, বন্ধ সব বিমানবন্দর