জুলাই বিপ্লব ছিল বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান। ২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক জারি করা সার্কুলারটিকে অবৈধ ঘোষণা করার পরপরই আন্দোলনটি কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়।
হাইকোর্টর রায়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা একে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। সেদিন সন্ধ্যাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের হয়, যা পরদিন আরও বিস্তৃত আকার নেয় এবং ছড়িয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা প্রান্তে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোবাশশের চৌধুরী শাকিল ও মারুফ বিন হাবীব আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হন। তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পাশে দাঁড়ান অনেক সহমর্মী মানুষ। সহিংসতার মধ্যেই রাজপথে ছিলেন “জুলাই যোদ্ধা” আলম ভাই। সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “রণক্ষেত্র মনে হচ্ছিল রাজপথটাকে, কষ্টে প্রাণটা নিয়ে ফিরেছি।” কারফিউ চলাকালে মেসে খাবার সংকট দেখা দেয়, কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয় কিছু রুটি ও মাংস।
আজিমপুর কলোনি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বাস করেন, সেটিকে রেড জোন ঘোষণা করে চারপাশ ঘিরে ফেলে পুলিশ। সেখানে হামলা চালানোর সময় নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন এক ব্যাংক কর্মকর্তা; গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। পুলিশ প্রথমে মরদেহ হস্তান্তরেও অনীহা দেখায়।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বেদনাবিধুর ঘটনা ছিল খালিদ হাসান সাইফুল্লাহর মৃত্যু। ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী খালিদকে ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
২০০৮ সালের ২৯ মে লালবাগের আমলিগোলায় জন্ম নেওয়া খালিদের বাবা কামরুল হাসান একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও হোমিও চিকিৎসক। আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই সক্রিয় ছিল খালিদ। ১৮ জুলাই আসরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিল সে, কিন্তু গুলির মুখে পড়ে প্রাণ হারায়। তার শরীরে শটগানের অন্তত ৭০টি ছররা গুলি পাওয়া যায়।
উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে ভরা দিনগুলোতে আশ্রয় চেয়েছিল বহু আন্দোলনকারী। ঝুম বৃষ্টিতে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। আশ্রয় দিয়েছিলেন একজন সহমর্মী বোন। হঠাৎ ফোন করে তারা জানায়, তাদের হলে রেড দেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দৌড়ে সহায়তায় ছুটে গিয়েছিলেন তিনি, পথে হোঁচট খেয়েও পিছু হটেননি।
রাত ২টা, আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশের হাজী বেগ মসজিদে চলছিল মুসল্লিদের অবস্থান। হঠাৎ পুলিশ এসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায় এবং ঘুমন্ত মুসল্লিদের জাগিয়ে তল্লাশি চালায়, কেউ অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কিনা খোঁজে। পরদিন সকালের আলো যেন নতুন জীবনের বারতা নিয়ে আসে, ফিরে পান হারিয়ে যাওয়া ভাইকেও।
জুলাই আন্দোলনের প্রতিটি দিন ছিল অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা আর রক্তের গল্পে ভরা। বাসা থেকে বেরোলেই ফেরার নিশ্চয়তা ছিল না, কিন্তু আহতদের পাশে দাঁড়াতে, জীবন বাঁচাতে পিছপা হননি “জুলাই যোদ্ধারা”। রোদ, বৃষ্টি, রেড এলার্ট—সব উপেক্ষা করেই তাঁরা নেমেছিলেন রাজপথে। তাঁদের একজন হতে পারার অনুভূতি গর্বের।
এই আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে নয়, ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সোচ্চার হওয়ার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
আমার বার্তা/আলিমা আফরোজ লিমা/এমই