পোশাকখাতের মতো আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা পেলে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া শিল্প থেকে বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। ২০৩৫ সালের মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ ১০ বিলিয়নেও উন্নীত হতে পারে বলে জানান তারা।
রোববার (২৫ মে) রাজধানীতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘চামড়া শিল্পের কৌশল নির্ধারণ: এলডিসি পরবর্তী টেকসই রপ্তানি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তারা।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
শিল্প উপদেষ্টা বলেন, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান নানাবিধ প্রতিকূলতা নিরসনে শিল্প মন্ত্রণালয় সহায়ক নীতি পরিবেশ প্রদানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, যার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। চামড়া শিল্পের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি বিস্তৃত ইকোসিস্টেম প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে চামড়া শিল্পের পরিবেশগত অবকাঠামো উন্নয়ন, সনদ প্রাপ্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে তার মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
সভায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, চামড়া খাতে সিইটিপির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাভারে স্থাপিত সিইটিপি’র ক্যাপাসিটি বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার এবং পিকসিজনে (কোরবানির সময়) এ খাতে চাহিদা থাকে ৩২-৩৫ হাজার কিউবিক মিটার, সিইটিপির সক্ষমতা ২০-২৫ হাজার কিউবিক মিটারে উন্নীতকরণে একটি টেকনিক্যাল টিম কাজ করছে।
তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ইটিপি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আরও ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এ খাতে পরিবেশদূষণ রোধে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে উদ্যোক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়েও সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি। চামড়া খাতে নতুন বাজার তৈরি, উদ্ভাবন ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বহির্বিশ্বে এ শিল্পের ইমেজ সংকট রয়েছে, সেখান থেকে থেকে আমাদের বের হতে হবে। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট না থাকার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি থেকে উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
‘চামড়া শিল্পের কৌশল নির্ধারণ: এলডিসি পরবর্তী টেকসই রপ্তানি’ শীর্ষক সভা/ছবি: বিপ্লব দিক্ষিৎ
তিনি আরও বলেন, সিইটিপি থাকলে সম্মিলিতভাবে ব্যয় কম হবে এবং মনিটর করা সহজ হবে এবং যে কোনোভাবেই এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এখাতে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সহজ হবে এবং এফডিআই আকর্ষণ সহজ হবে। যেহেতু আমাদের প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন পরিলক্ষিত হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সিইটিপি পুরোপুরি চালু করা যায়নি। ফলে এ খাতের কাঙ্ক্ষিত রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলডব্লিউজি-এর মতো আমাদের আন্তর্জাতিক কোনো সনদ না থাকায় বৈশ্বিক বাজার বাংলাদেশ প্রতিযোগী হয়ে উঠছে না। এ খাতের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্যপ্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে, এছাড়াও চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সের অনুপস্থিতির বিষয়টিও অন্যতম কারণ। চামড়া খাতের রুগ্ণ শিল্প-প্রতিষ্ঠান এবং যারা এ খাত থেকে বের হতে আগ্রহী, তাদের প্রস্থানের সহজ সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে, যেন বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ প্রাপ্তি সহজ হয়।
তিনি বলেন, চামড়া শিল্পের বার্ষিক রপ্তানি ১.২ হতে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে, তবে তৈরি পোশাকখাতের মতো আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাতে বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভব, যা ২০৩৫ সালে ১০ বিলিয়নেও উন্নীত হতে পারে। চামড়া খাতের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে ক্লাইমেট ফাইন্যান্স ফান্ড হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চামড়া শিল্পটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তাই এটিকে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ডব্লিউটিও অনুবিভাগ) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ আসবেই, এগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারলে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হবে। পরিবেশ ও শ্রমখাতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতের জন্য বেসরকারিখাতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সিইটিপি’র সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকার ও বেসরকারিখাত একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, আগামী ১৫ বছরে আমাদের অর্থনীতি দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় জরুরি। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে।
তিনি বলেন, সম্ভাবনাময় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিডা গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছে, যার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। সম্প্রতি বিডা কর্তৃক প্রবর্তিত হিটম্যাপে চামড়া খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্স অনুসরণে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এ খাতের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি চামড়া শিল্পে ব্যক্তিখাতে প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপনে গ্রিন ফান্ড হতে স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তার আহ্বান জানান।
সভায় অন্যদের মধ্যে বিসিএসআইআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সালমা আহমেদ, বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান, জেনিস সুজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির খান এবং অস্টান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা বক্তব্য রাখেন।
আমার বার্তা/এমই