বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি সাবেক প্রক্টর ড. শরিফুল ইসলামকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য তার বিভাগের শিক্ষার্থী, কিছু সমন্বয়ক এবং আওয়ামীপন্থি শিক্ষক একজোট হয়ে মাঠে নেমেছে।
বৃহস্পতিবার আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার্জশিট জমা দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক প্রক্টর ড. শরিফুল ইসলামের পক্ষে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। বিকেল ৩টার দিকে ছাত্রদের আন্দোলনে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশ যোগ দেন।
এরপর আওয়ামী লীগ পন্থি শিক্ষকদের পরামর্শে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিকেল সাড়ে ৫টায় ওই শিক্ষকদের নেতৃত্বে শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ট্রাইব্যুনাল তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ ও সাবেক প্রক্টরের পক্ষে একটি মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কট্টর আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও নীল দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ড. আপেল মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক ‘হলুদ দল’র সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিয়ুর রহমান প্রধান। তিনি ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনের নির্বাচনী লিফলেট বিতরণ করেছিলেন।
মানববন্ধনে আরও উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সদস্যরা। যেমন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও হলুদ দলের সদস্য রসায়ন বিভাগের ড. বিজন মোহন চাকি, নীল দলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান, নীল দলের সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, নীল দলের দফতর সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম, নীল দলের কার্যকরী সদস্য মো. সানজিদ ইসলাম খান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীলের সদস্য মোহাম্মদ রফিউল আজম খান। বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হক, অধ্যাপক ড. রাফিউল আজম খান, ছাত্রলীগের পোস্টেট নেতা উপধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান আবির, ছাত্রলীগের কর্মী রায়হান কবীর। সমন্বয়কদের মধ্যে এস এম আশিকুর রহমান আশিক, রহমত আলী, নয়ন, শাহরিয়ার সোহাগ, হাজিম উল হক, আরমানসহ অনেকে ছিলেন।
জানা যায়, বেরোবি ছাত্রলীগের উপধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান আবির ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি পোমেল বড়ুয়ার অনুসারী। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের হাত থেকে পেয়েছিলেন জয় বাংলা অ্যাওয়ার্ড।
মানববন্ধনে বক্তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আহ্বান জানান, প্রকৃত দায়ীদের বিশেষ করে যাদের নির্দেশে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজকেও এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
তারা বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি যৌক্তিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকালে পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষণের শিকার হন। ওই ঘটনায় শহীদ হন আবু সাঈদ ও গুরুতর আহত হন শতাধিক শিক্ষার্থী। এই নির্মম পুলিশি হামলার চিত্র শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।
ঘটনার পর স্বৈরাচারী সরকারের পতনের প্রেক্ষিতে শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বাদী হয়ে এবং আন্দোলনের সহযোদ্ধারা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। শুরুতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব ছিল পিবিআই’র ওপর, পরে তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল থেকে নেওয়া সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে তারা তদন্ত করলেও, গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো ট্রাইব্যুনাল সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সম্পৃক্ততা এড়িয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কিছু ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে যারা ঘটনার পরোক্ষভাবে দায়ী হলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা দায়মুক্ত রয়েছেন।
২৬ জুন ২০২৫ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করলেও কোনো পুলিশ সদস্যের নাম প্রকাশ করেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রশাসনিক অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, যা প্রক্রিয়াগত বিচ্যুতি ও বিচার প্রহসনের সমতুল্য বলে উল্লেখ করা হয়।
ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রিফাত হোসেন রাফি বলেন, আমি প্রথমেই বলবো সাবেক প্রক্টর সরাসরি দায়িত্বের জায়গা থেকে দোষী এবং তার বিচার হতেই হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের তার নিঃশর্ত মুক্তি চাওয়াটা অযৌক্তিক, কারণ তিনি প্রক্টর থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ, আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রবেশ করে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে যাতে পরবর্তীতে আবু সাঈদ ভাই শহীদ হন। তাই ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ন্যায়বিচার দাবি করতে পারত, কিন্তু বিষয়গুলো ভিন্ন খাতে রূপান্তর করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। আমি চাই সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে শহীদ আবু সাঈদ হত্যার বিচার হোক।
ক্ষোভ প্রকাশ করে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তুহিন রানা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও আবু সাঈদের সহযোদ্ধা হিসেবে বলতে চাই, আবু সাঈদের হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন দাবানল পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের সাহায্য ছাড়া পুলিশ গুলি করার সাহস পেতো না।
তুহিন আরও বলেন, আমি মনে করি তাদের দাবিগুলো আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত, কিন্তু উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে ক্যাম্পাসকে আবারো অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে আমরা মেনে নিবো না। আমরা দেখতে পাচ্ছি এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী রয়েছে। সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম অবশ্যই দোষী, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। কোনো ধরনের মব আমরা মেনে নিবো না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষক ও প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান বলেন, এখানে আওয়ামী, বিএনপি, জামায়াত বড় কথা নয়, আমাদের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশি হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছে। সঠিক বিচার আমরা সবাই চাই, তবে কেউ যেন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শাস্তি না পায় সেটিও আশা করি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী বলেন, এটাতো আইনের বিষয়, তারা কী করছে এখন তো আমরা জানি না। সাবেক প্রক্টর শরিফুল এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিলেন কি না, তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করলে জানা যাবে। তারা কী তদন্ত রিপোর্ট দেবে তা তো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে দেবে না।
আমার বার্তা/এল/এমই