সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের অন্যতম বিলাসবহুল এলাকায় গড়ে ওঠা একটি যৌন ব্যবসা ও নারী নির্যাতন চক্রের মূল হোতা হিসেবে চার্লস মোসিগা নামের এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে বিবিসির অনুসন্ধানী দল।
পরিচয় গোপন করে কাজ করা বিবিসির এক প্রতিবেদককে মোসিগা জানান, একটি সেক্স পার্টির জন্য তিনি ন্যূনতম এক হাজার ডলারে নারী সরবরাহ করতে পারেন। এসব নারী গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ‘প্রায় সবকিছুই’ করতে প্রস্তুত। মোসিগা নিজেকে লন্ডনের সাবেক বাসচালক হিসেবে পরিচয় দেন।
দুবাইয়ের ‘উন্মত্ত’ সেক্স পার্টি নিয়ে নানা গুজব, ব্যঙ্গ এবং জল্পনা বহু বছর ধরেই প্রচলিত। টিকটকে এ-সম্পর্কিত একটি হ্যাশট্যাগ দেখা হয়েছে ৪৫ কোটিরও বেশি বার। এসব কনটেন্টে অভিযোগ ওঠে, অর্থলোভী কিছু নারী ইনফ্লুয়েন্সারের ছদ্মবেশে বিলাসী জীবনযাপনের খরচ জোগাতে গোপনে যৌনকর্মে লিপ্ত হন। তবে বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।
প্রতারণার ফাঁদে আফ্রিকান তরুণীরা
উগান্ডার বেশ কয়েকজন তরুণী বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা ভাবেননি যৌনকর্মে নিয়োজিত হতে হবে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন, তারা দুবাইয়ে গিয়ে সুপার মার্কেট বা হোটেলে কাজ করবেন।
‘মিয়া’ (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণী বলেন, মোসিগার এনে দেওয়া এক গ্রাহক নিয়মিত মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করতে চাইতেন। মোসিগার চক্র তাঁকে প্রতারণার মাধ্যমে এই পেশায় জড়িয়েছে বলেও জানান তিনি।
মোসিগা যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কেবল বাসা ভাড়া পেতে সহায়তা করেন এবং নারীরা তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যান, কারণ তাঁর ধনী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
মৃত্যু, আত্মহত্যা না হত্যা
বিবিসি আরও জানায়, মোসিগার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’জন নারী দুবাইয়ের সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে মারা গেছেন। যদিও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি আত্মহত্যা; তবে নিহতদের পরিবার ও বন্ধুরা বিশ্বাস করেন, এগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা হয়নি।
মারা যাওয়া নারীদের একজন মোনিক কারুঙ্গি, যিনি পশ্চিম উগান্ডা থেকে এসে মোসিগার ব্যবস্থাপনায় থাকা একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। সেই ফ্ল্যাটে একই সঙ্গে থাকতেন প্রায় ৫০ জন নারী। ওই ফ্ল্যাটটিকে মিয়া ‘বাজার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মোনিকের বোন রিতা জানান, তাঁর বোন দুবাই গিয়েছিলেন একটি সুপার মার্কেটে কাজ করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
মিয়া বলেন, মোনিক মোসিগার চাহিদা মানতে অস্বীকৃতি জানাতেন এবং চক্র থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। তিনি একটি চাকরি পেয়ে অন্য ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাসার বারান্দা থেকে ২০২২ সালের ১ মে তিনি পড়ে যান। মোনিকের মৃত্যুর মাত্র চার দিন আগে তিনি একটি সেলফি তুলে পোস্ট করেছিলেন।
ঋণের নামে শোষণ, বিকৃত যৌনতা
মিয়া জানান, তিনি দেশে ফেরার কথা বলতেই মোসিগা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং জানান, মিয়ার কাছে তিনি ২ হাজার ৭১১ ডলার পাবেন। সময়মতো পরিশোধ না করলে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
মোনিকের আত্মীয় মাইকেল (ছদ্মনাম) জানান, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মোসিগার কাছে মোনিকের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৭ হাজার ডলার। মোনিক প্রায়ই কান্নাভেজা ভয়েস নোট পাঠিয়ে সহায়তা চাইতেন।
মিয়া বলেন, বেশিরভাগ গ্রাহক ছিলেন ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। তাঁদের অনেকে ছিল চরম বিকৃত যৌনচাহিদায় আসক্ত। নিচু গলায় তিনি বলেন, এক গ্রাহক মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করে সেটি খাওয়াতে চাইতেন।
মোসিগার গোপন জীবন, গোপন পরিচয়
চার্লস মোসিগাকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। অনলাইনে তার পেছন থেকে তোলা একটি ছবিই ছিল অনুসন্ধানীদের একমাত্র সূত্র। বিভিন্ন নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেন তিনি। ছদ্মবেশে অনুসন্ধান ও চক্রের এক সাবেক সদস্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে দুবাইয়ের জুমেইরাহ এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়।
‘ট্রয়’ নামে এক ব্যক্তি জানান, মোসিগা কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়ি, বাসা বা অন্য যে কোনো কাজে তিনি ট্রয়সহ অন্যদের নাম ব্যবহার করতেন।
মৃত্যুর পরও অন্ধকারে পরিবার
মোনিকের পরিবার আজও তাঁর মরদেহ পায়নি। বিবিসি অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাকে দাফন করা হয়েছে দুবাইয়ের আল কুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে। মোনিকের বোন রিতা বলেন, তাদের পরিবার এখন শুধু শোক নয়, আতঙ্কেও রয়েছে, যেন এমন ঘটনা আর কারও না ঘটে চার্লস মোসিগার কাছে বিবিসি তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা।’
সূত্র: বিবিসি