চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জন আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ মামলা থেকে খালাস পেলেও এখনই মুক্তি মিলছে না তার। কারণ, একই ঘটনায় আরেক মামলায় তার দণ্ড বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী।
মামলাটিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পরেশ বড়ুয়ার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে আসামি মহসীন, এনামুলসহ পাঁচজনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান। নিজামী ও বাবরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আবদুর রহিম ও লিয়াকতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ আহসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। পলাতক আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হাসনা বেগম শুনানি করেন। নুরুল আমিনের পক্ষে আইনজীবী সাধন কুমার বণিক ও মো. মহিউদ্দিন শুনানিতে অংশ নেন।
>> বাবরসহ ছয়জন খালাস
রায়ে আদালত বলেছেন, লুৎফুজ্জামান বাবর, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসীন উদ্দিন তালুকদার, তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। যে কারণে তারা অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার অধিকারী। তাদের খালাস দেওয়া হলো। ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, মারা যাওয়ায় তার আপিল মেরিটে নিষ্পত্তি করে অব্যাহতি (বাদ) দেওয়া হলো।
মামলাটিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। তার বিষয়ে রায়ে আদালত বলেছেন, বিচারের শুরু থেকেই তিনি পলাতক। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার অধিকারী।
>> পরেশ বড়ুয়ার যাবজ্জীবন
মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। তার বিষয়ে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, শুরু থেকেই তিনি পলাতক। তার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে তার সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হলে ন্যায়বিচার হবে। তাই সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
>> ছয়জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড
বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৬ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারা হলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, এনএসআইয়ের সাবেক উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, তৎকালীন পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান, শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ ও ট্রলারমালিক হাজি সোবহান। বিচারিক আদালতের রায়ে তাদের ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। সেটা জরিমানা পরিবর্তন করে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
>> রহিমের জরিমানা কমে ১০ হাজার
ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিমের মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। তার বিষয়ে রায়ে হাইকোর্ট বলেন, মারা যাওয়ার কারণে তার আপিল অ্যাবেট (পরিসমাপ্তি) ঘোষণা করা হলো। বিচারিক আদালতের দেওয়া জরিমানার আদেশ সংশোধন করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা হলো।
বাবরের বিষয়ে তার আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০ ট্রাক–সংক্রান্ত অপর একটি মামলায় দণ্ড থাকায় এখনই বাবর কারামুক্তি পাচ্ছেন না। ওই মামলায় বাবরের করা আপিল হাইকোর্টে শুনানির জন্য রয়েছে।’
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। এর বিচারও একসঙ্গে শুরু হয়। অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয় একই আসামিদের।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছায়, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অন্যদিকে দণ্ডিত আসামিরা সাজার রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন।
এর আগে ওই মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। দণ্ডিত ১২ জন পৃথক আপিল করেন।
মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর গত ৬ নভেম্বর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ১৩তম দিনে শুনানি শেষে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স নাকচের পাশাপাশি কোন ক্ষেত্রে আপিল মঞ্জুর আবার কোনো ক্ষেত্রে, আপিল নামঞ্জুর করে সাজা সংশোধন করে আজ রায় দেওয়া হয়।
আমার বার্তা/এমই